অনুপম
বলছি
সেলিব্রিটি
কোন প্রক্রিয়ায় তৈরি হন বলুন তো? কখন একজনের মুখের ছবি রাস্তার পাশে বিপুল
হোর্ডিং-এ আমাদের শিহরিত করে? কখন তিনি আমাদের শোবার ঘরের দেওয়ালে বা বাথরুমের
দরজায় পোস্টার হয়ে শোভিত হন? তাঁর সাধনা আর নিষ্ঠার পাশাপাশি তাঁর ভক্ত এবং
উপভোক্তাদের মনঃস্তত্ত্ব একটা বিরাট ব্যাপার। সামান্য মানুষকে অসামান্য দেখতে
মানুষ চায় না। অসামান্যকেও চায় না সামান্য রূপে। সে চায় অসামান্য হয়েই তিনি
জন্মাবেন। অসামান্যই থাকবেন। তাঁর সর্বত্রগামী কৌলীন্য থাকবে। এবং তিনি পাশের
বাড়ির লোক হবেন না। পাশের বাড়ির লোক হলে সব মাটি। তাঁকে তখন জলের উপর দিয়ে হেঁটে
দেখাতে হবে তাঁর মধ্যে অসামান্যতা কিছু আছে। স্পর্শ করেই ভাল করে দিতে হবে
দূরারোগ্য ব্যাধি। নাহলে পাত্তা পাবেন
না।
সিনেমা স্টারদের কথা বাদ দিন। স্বয়ং ভগবান গৌতম বুদ্ধকেই ধরুন। যদি খুব
ক্রুদ্ধ না হন, যদি আহত বোধ না করেন, তাহলে বলি আমার জানা অনুসারে গৌতম কোনো
রাজপুত্র ছিলেন না। ভক্তির বদলে যুক্তি আর অনুসন্ধিৎসার দ্বারা সন্ধান করলেই জানা
যায়, বুদ্ধদেব তাঁর প্রথম জীবনে কপিলাবস্তু শহরের কাছাকাছি গ্রাম লুম্বিনীর একজন
সমৃদ্ধিশালী কৃষকের পুত্র ছিলেন। ওঁর পরিবার নিজেরাই কৃষিকাজ করত। তাঁর সময়ের অনেক
শ্রমণ সঙ্ঘের একটি ছিল গৌতম বুদ্ধের। বিপুল প্রতাপ তাঁর ছিল না। পিতৃঘাতক
অজাতশত্রুর প্রতিও বুদ্ধ কোনো বিরূপতা প্রদর্শন করতে পারেননি। হয়ত সেই ইচ্ছা তাঁর
ছিল না। কিন্তু বুদ্ধের এই মানবিক পরিচয়ে বৌদ্ধ ঐতিহাসিকদের মন ভরল না। তাঁরা
তাঁকে রাজপুত্র বানালেন। তাঁর জন্ম নিয়ে সাদা হাতির রূপকথা বানালেন। তিন-তিনটে
প্রাসাদ গড়ে দিলেন। অজস্র দাসদাসী দেওয়া হল তাঁকে। সিদ্ধার্থ না কি জরা দেখেননি,
মৃত্যু দেখেননি, প্রাসাদের মধ্যেই থাকতেন, ইত্যাদি। প্রকৃত ঘটনা হল বুদ্ধ ছিলেন
লুম্বিনীর এক সামান্য পরিবারের অসামান্য যুবক, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকত এক আশ্চর্য
শান্ত ও বিদ্রুপাত্মক হাসি, একজন সাধারণ ভূস্বামীর অসাধারণ সন্তান। বুদ্ধত্ব লাভের পরে শিষ্য সংগ্রহের জন্য নিজেকেই উদ্যোগী হতে হয়েছিল, শিষ্য
সহজে জোটেওনি। যখন তিনি জন্মস্থান কপিলাবস্তুতে গিয়েছিলেন, এবং শুধু রাতের
আশ্রয়টুকুর জন্য যে কাঠখড় তাঁকে পোড়াতে হয়েছিল, সেই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সন্ন্যাস
নেওয়ার আগে যেমন ও শহরে তাঁকে খুব বেশি লোক চিনতই না, সন্ন্যাস নেওয়ার এবং
বুদ্ধত্ব লাভের পরে চিনলেও বিশেষ গুরুত্ব দিত না।
গৌতম বুদ্ধের জীবনের লড়াইটা যে ছিল
একইসঙ্গে দার্শনিক ও রাজনৈতিক, এবং সেটা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রতাপের বিরুদ্ধে,
যাগযজ্ঞের অহেতুক আড়ম্বরের বিরুদ্ধে, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল একজন সাধারণ মানুষের তৈরি
অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে আরেক সাধারণ মানুষের মতোই গাছতলায় মাটিতে শুয়ে, সেই
যুক্তিবাদী বিপ্লবী বুদ্ধকেই কিন্তু একসময় বানিয়ে দেওয়া হল বিষ্ণুর নবম অবতার। গৌতম বুদ্ধ নামক রক্তমাংসের মানুষটিকে রেখে দেওয়া হল, কিন্তু তাঁর দর্শনকে
অন্য পথের পাথেয় করে দেওয়া হল।
আবার, যদি কুপিত না হন, তাহলে বলি আমার জানা অনুসারে যিশু খৃস্টের ক্ষেত্রেও
তাই। এমন মত আজ অনেকেই শুনে থাকবেন যে, রোমান শহর সেফোরিসের কাছাকাছি নাজারেথ
গ্রামের একজন ইহুদী পাথর মিস্ত্রী ছিলেন যিশু। গায়ের রং কালো। সাধারণ মানুষ।
কিন্তু তাঁর বুকে জ্বলত রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন। একজন গেরিলা নেতাই তো
ছিলেন যিশু। মসিহা আসবে বলে তাঁর দেশের মানুষরা যে ছেলেভোলানো গল্পগুলোতে বিশ্বাস
করত, যিশু তাঁরই সমসাময়িক এবং গুরুস্থানীয় জন দ্য ব্যাপ্তিস্তকে অতিক্রম করে সেটায়
ঢুকে গেলেন। তিনি হলেন অত্যাচারিত লাঞ্ছিত অপমানিত জুডিয়ার বিপ্লব, সেকালের একজন
সুভাষ চন্দ্র বসু বা চে গ্যেভারা। তাঁকে তাঁর হত্যাকারী রোমানরাই পরে আত্মসাৎ করল। তাঁরই বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য তাঁর
কিংবদন্তিকে আত্মসাৎ করল। তাঁকে রোমান দেবতার আদলে একজন দেবতা প্রায় বানিয়ে দিল।
মিথ্রাস নামক রোমান দেবতার জন্মদিন ২৫শে ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন হল। জন্মকাহিনিতে
শ্রীকৃষ্ণের আদল এসে গেল। তাঁর বাণীগুলি রচিত হল বুদ্ধের আদলে। যিশুর কালো চেহারা
হয়ে গেল শ্বেতাঙ্গ। এমনকি তাঁর নগণ্য পরিবারকে মুছে দেওয়ার জন্য তাঁকে বানানো হল
কুমারী মাতার পুত্র, যাতে তাঁর খেটে খাওয়া বাপ-ভাইরা কেউ ইতিহাসে নিজেদের
রক্তমাংসের পরিচয় নিয়ে না থাকে, চার্চের অসুবিধা হবে সেটায়। যিশুকে তাঁর মনুষ্যত্ব থেকেই ছিঁড়ে নিল রোমানরা। মন্দিরের মতোই ঘন্টা বাজতে
থাকল রোমানদের প্রতিষ্ঠিত চার্চে।
বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন অংশ জুড়ে নিজেদের মনের মতো ইমেজে এই যে তাঁকে
রোমানরা বানাল, এবং তিনি এক মহীয়ান পুতুল হলেন, তাঁর মা হলেন আরেক পুতুল, সম্রাট কনস্ট্যানটাইন তাঁর সামনে প্রসন্ন
চিত্তে প্রণত হলেন, যিশুকে সত্যিকারের হত্যা সেটাই ছিল। ক্রুশ তো তাঁকে মারতে
পারেনি। মারতে পারলে এই ইমেজ তৈরির প্রয়োজন, এবং তাঁকে নিজেদের অন্তর্গত করার
পরিকল্পনা রোমানদের করতেই হত না। ক্রুশ তো যিশুর অমরত্বেরই প্রতীক।
সেই ক্রুশকে সামনে রেখেই যিশুর নিজের মতবাদ মুছে গেল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম
রাজনৈতিক চালটি দিল রোমানরা। জুডিয়ার মতো উপনিবেশগুলোর বিদ্রোহের আর কোনো নৈতিক
ভিত্তি থাকল না। ভূমিপুত্রদের সহজাত মিস্টিসিজমের কোনো জায়গা থাকল না। গূঢ়
তত্বগুলোর জায়গা থাকল না। যিশুর মুখে চাপল সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের আধিপত্যের পক্ষে
সুবিধাজনক কথাবার্তা, যেগুলো শুনতে খুবই ভাল, কিন্তু অমন নিরাপদ কথাবার্তা তিনি
কস্মিনকালেও বলেননি।
অত্যাচারিত লাঞ্ছিত নির্বাসিত নিহত আদি গেরিলা খৃস্টানদের কোনো চিহ্নই রাখা হল
না চার্চের শীতল ইতিহাসে। চার্চ আদি এবং প্রকৃত হলেও প্রান্তিক খৃস্টানদের
প্রাথমিক রাজনৈতিক ইতিহাসটা পুরোপুরিই ঢেকে দিল। প্রকৃত খৃস্টানদের নিরপরাধ
রক্তপাতের উপরে তারা চাপিয়ে দিল নিজেদের রক্তপায়ী প্রাতিষ্ঠানিকতা। সেটাই হয়ত
আবহমান কাল চলত যদি না মার্টিন লুথার কিং এসে পড়তেন নবজাগরণের অবকাশে। সেটাও
অবিশ্যি রক্তপাতের ইতিহাস।
এই যে যিশুর মূর্তির মুখে রোমান আদল, বুদ্ধদেবের মূর্তির মুখে গ্রিক আদল, ধনীর
বখাটে ছেলের টি-সার্টে চে গ্যেভারার মুখ, এগুলো কি বৃহৎ ট্র্যাজিডি নয়? যেমন বাংলা
সিনেমার গরীব নায়ক তার ধনী প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য লড়াই করে, এবং সিনেমার শেষে
জানা যায় সে আসলে একজন ধনীরই হারিয়ে যাওয়া ছেলে, নায়িকার ষড়যন্ত্রী বাবাই নায়কের
ধনী এবং উদার বাবাকে মেরে সম্পত্তি গ্রাস করে নিয়েছিল, এখন নায়ক এসে নায়িকার
বাবাকে দু-চারটে ঢিসুম ঢিসুম করে জেলে পাঠিয়ে দিল, অতএব এখন আর বিবাহে বাধা রইল না।
এই মধুর মানসিকতা বাঙালির মধ্যে ভরপুর। সে তার বাড়ির পাশের পাহাড়কে কোনো
গুরুত্বই দ্যায় না। অনেক দূরের টিলা দেখতে যায় ছুটি পেলে সপরিবারে। কামারপুকুরে
গিয়ে রামকৃষ্ণ সম্পর্কে, বীরসিংহে গিয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে, রাধানগরে গিয়ে
রামমোহন সম্পর্কে, বাঁকুড়ায় গিয়ে রামকিঙ্কর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখুন। দেখবেন স্থানীয় লোকেদের মধ্যে ওঁদের নিয়ে আবেগের কোনো আতিশয্যই নেই। কিন্তু
আপনি তখন রূপকথাগুলোকে স্পষ্ট চিনতে পারছেন, মানুষগুলোকে মানুষ হিসেবে ভালবাসতে
সুবিধা হচ্ছে, আর, আপনার নিজের মনুষ্যত্বে অন্য একরকম পরত সৃষ্টি হচ্ছে, চিনতে
পারার আত্মবিশ্বাস আর চিনে নেওয়ার সংকল্পের পরত।
কাছের মানুষকে যে তার প্রকৃত স্বরূপে চিনতে পারে, স্বীকৃতি দিতে পারে, তার
মধ্যেই চেতনার বিকাশ হয়েছে বুঝতে হবে।
দূর থেকে পাহাড়কে তো সবাই চিনতে পারে। ওতে কোনো কেরামতি নেই। বরং আমরা এবার
পাশের মানুষটির দিকে একটু তাকাই। দেখি তার মধ্যে কতখানি অসাধারণত্ব লুকিয়ে আছে।
সেই যে আবিষ্কার ,তা তেলেনাপোতা আবিষ্কার, নাকি
আমেরিকা খুঁজে বের করা, তা হয়ত আপনার আনন্দের
মাত্রাই আপনাকে বলে দেবে।
অনুপম মুখোপাধ্যায়
পরিচালক-
বাক্ অনলাইন