বাক্‌ ১৪৪ ।। পলাশ চৌধুরী



দ্যা ম্যাড ভ্যালি


সময় যা পেরিয়ে যাওয়ার ছিল, নিয়ম যা পালন করার ছিল, আর এই যে আহত আত্মসমর্পণ, যেটা করতে চায়নি বেখেয়ালি আচরণ করেও সেটাও করে ফেলতে হল। এই হকারি কলহে আত্মার সঙ্গে কথা বলতে থাকে ঝুমা। যদি হঠাৎ ছাল উঠে যায় জীবনে, তবে এরকম গ্লোবাল ম্যাডনেস পৃথিবীর জন্য ভাল। অন্তর্ভুক্ত সঞ্চয়ের বাইরে ভাবতে হয় না তাহলে।
ড্রেনেজ ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে যে শহরগুলিতে অথচ পথচলা সহজ হচ্ছে না, এসব পরিবর্তন পরিবারের খুঁটিনাটি পড়লেও আমারই খড়কুটো বেরিয়ে আসবে। প্রাক্তন ঈষদুষ্ণ আবহাওয়ায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হয়ে বিছানায় নেমে আসবে। এসব ভাবনা প্রদর্শনী করে চলেছে যারা তারাই পৃথিবীর প্রাচীন বল। কর্তার পরিচয় দিয়ে সংসার, সংবাদ, সম্মেলন সবই করে ফেলা যায়, কিন্তু একা যখন, সংগ্রাম প্যাঁচানো ত্যানাগোলো খুলে, সংখ্যা হয়ে বসে থাকে।
          বিস্তর ফাঁকা, যেটা কাম্য হয় ব্যস্ততার অলিগলিতে ঝুমা সেই গলির বর্তমান সরকার। এখন সে যার সঙ্গে কথা বলছে সেই পৃথিবীর এখন সভ্য জ্বর। আসলে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট ডিফেন্স ভেঙে পড়ে যাচ্ছে তার। 
          পরিবার বলতে ঝুমার এই আকস্মিক পরিবর্তন যেখানে জীবন নিয়ে জলকেলি দ্যাখে তার বিস্ফারিত কথামালা। পৃথিবীকে প্রশ্ন করে সে— ‘আমি কি একাই যে হারিয়ে গিয়েছি, নাকি আমার সঙ্গেই সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী?
          বেখেয়াল কিছুক্ষণ, নিস্তব্ধতায় যেন কেউ তার প্রশ্নের জবাবে তাকে বিশ্বরূপ দর্শন করাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা ভাঙে, ঝুমা আবার বলতে থাকে— ‘তাহলে হারিয়ে যাওয়াটাই প্রাসঙ্গিক! তথাকথিত ইতর-ভদ্র সকলের থেকে নিজেকে আলাদা রেখে এগিয়ে চলাই আসল জীবন! যৌবন পেরিয়ে যে যৌন যোগাযোগ, তার প্রতিটি লয়ে যে বীজ গর্ভে পোঁতা হয় তাই আবিষ্কার!’
          অপরপক্ষ থেকে যেন সম্মতি পেয়েই সেই ভাবনার হারিয়ে যায় আবার সে, আবার বিড়বিড় করতে থাকে নিজের মনেই।


ঝুমার আত্মার পরিবারের বাইরে তার যে নিজস্ব শারীরিক পরিবার আছে সেখানে তার স্বামী সহদেব, দুই মেয়ে ও এক ছেলে বর্তমান। সামঞ্জস্য মেনে চলা ঝুমার পক্ষে অসম্ভব, ফলত সাংসারিক জীবনের সাংবাদিক কলহ লেগেই থাকে। যুগের পিছনে ছুটতে গিয়ে মর্ডান হয়েছে তার দুই মেয়ে, পুত্রসন্তানটি দারিদ্রের শৈশব ন্যাংটো হয়ে উপভোগ করে, সভ্যতার মুখে দলাদলা থুতু ছিটিয়ে বড় হচ্ছে।
          এসবকিছুর পরেও পিতার স্নেহে কোনো কার্পণ্য নেই সন্তানদের জন্য। দারিদ্রের শীর্ণতা তার শিরা-উপশিরায় অলিম্পিক খেলে। 
          এই গ্রামীণ জনপদের মেঠো পথে ঝুমা যে ঝুঁকির চিহ্ন রেখেছে, তা গ্রামবাসীদের কাছে বেশ উপভোগ্য। এমতাবস্থায় দৈনিক কার্ফু বিজ্ঞাপনে প্রচলিত কার্গিলসম সহদেবের জীবনে। পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্রের সমস্ত ঝুঁকি সামলেও স্ত্রীর প্রতি তার কর্তব্যও অবাক করার মতো। সারাদিনের ব্যস্ততা, রাত্রির সমস্ত ক্লান্তি মেখে ঘরে ফিরেও স্ত্রীর উদ্দেশ্যে তার স্তোত্রগীত চিত্তহরণ করার মতো— ‘যেখানে খোলা জানালাই শ্রান্ত স্রোত দূর করে দিতে পারে, সেখানে এরম সূচের পাথরে বসে তুলোর কল্পনা করার দরকার নেই। একটু বুঝে দ্যাখো, আমার এই কেমিক্যাল মাখা জীবনে তোমাদের জন্য একটু-আধটু আনাজ জুটানোর সামর্থ্য আছে মাত্র, তোমার এই ভাবনার আকাশে কুসুম ফুটিয়ে তোলা আমার পক্ষে অসম্ভব। সন্তান, সংসার সবই তোমার, আমি ডিগ্রি সেলসিয়াস মাপতে পারি শুধু, তাপ তো তোমাকেই উৎপাদন করতে হবে।’
          হঠাৎ একটা হাসির শব্দ পাওয়া গেল শুধু তারপর সব চুপ।


দৈনন্দিন লাটাইয়ের ন্যায় জীবনে ঘুরে চলেছে পৃথিবী, বয়ে চলেছে সময়, নিয়ম মেনে সবই হচ্ছে, সূর্য উঠছে, আঁধার নামছে, চাঁদ উঠছে, ঝুমাও পৃথিবী দেখে চলেছে নিজের খেয়ালে, যেন এক অদ্ভুত নেশা অবিরাম গ্রাস করছে তাকে, কথাও বলছে অনবরত শুধু তারই সঙ্গেচিকিৎসা, বিজ্ঞান সব পেরিয়ে তার এই অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির লড়াই নিজের সঙ্গে নিজের।
অনেকে তাকে পাগল বলে, অনেকে ভাবে শয়তান, কেবল সে জানে এই ব্যবহার ব্যাকরণ শেষ হলেই পৃথিবীর চোখে চোখ রাখা যায়।
আবার পৃথিবীর কাছে প্রশ্ন রাখে ঝুমা— ‘আমি কি একাই পাগল, নাকি সমস্ত সভ্যতার পাগলামো লুকিয়ে রাখতে পাগল সাজিয়ে রাখা হচ্ছে আমাকে?’
          আবার চুপ, পৃথিবী উত্তর রেখে যাচ্ছে ঝুমার কাছে ঝুমা ব্যক্ত করছে পৃথিবীর সম্পদ। এভাবে— ‘আসলে পাগল সবাই, কেউ ধর্মে, কেউ কর্মে, কেউ মর্মে। আর যারা আমাকে পাগল দেখে পাগল ভাবে আসলে আমি তাদের গোষ্ঠী থেকে ভিন্ন এবং আমার মতো মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কম, তাই আমাকে পাগল সাজিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ।’


তখন রাত অনেক, সহদেব এসে বসেছে ঝুমার পাশে পারলৌকিক ক্ষুধা তার চোখে মুখে। ঝুমা তার অপস্রিয়মাণ স্পর্শ মৃদু করে হাত রাখে সহদেবের হাতে। সহদেব তাকে বোঝাতে শুরু করে আবার— ‘লোপাট যা কিছু হওয়ার, তা হবেই। ম্রিয়মাণ থাকত যদি লহমা তাহলে জানা যেত অক্ষর লেখা হয় কেবল সুড়ঙ্গে। আর যত পথ দেখবে সবই শক্তির, শুধু সুড়ঙ্গটুকু মুক্তির।’
          এই প্রথম ঝুমা না হেসে ঝরে পড়তে শুরু করল সহদেবের শরীরে। অজস্র উদাসীন বীজ ছেড়ে যেতে হবে তাকে পৃথিবীর জন্য। যাতে তাকে একাকে ভিন্ন চোখে না দেখা হয়, যাতে শুধু তাকে একাকে পাগল না বলা হয়।


আসলে ঝুমা কলম ধরতে চেয়েছিল প্রথার বিরুদ্ধে, আর কলমই হল জীবনের সবচেয়ে জটিল অধ্যায়। যতটা অধ্যাপক জীবন, তার অধিক শিক্ষা দেয় কলম। আসলে শিক্ষা যেটাকে ভাবা হয় সেটা ঠিক শিক্ষা নয়, প্রকৃত শিক্ষা ভাবতে পারার আকাশ পালটে দেয়। অতল সমুদ্র থেকে গুনে গুনে দু’-চারটে নুড়ি কুড়িয়ে নিলেই কলম জয়ী হয় না এটা জানত ঝুমা।
অজস্রতা যেখানে শেষ হয়, ঠিক তারপরেই কলমের ভাবনার শুরু আসলে ঝুমা কোনো পরিবারের প্রতীক নয়, ঝুমা একটা ভিন্নমাত্রার কলম। যে লিখতে চেয়েছে একা থাকার লড়াই, গোষ্ঠীবিরোধ, অসাবধানি ইতিহাস।  
          ভিন্ন মানেই পাগল, ভিন্ন মানেই শয়তান, এরকম ভাবনার তালুতে যারা আঘাত দেয় তারা জানে আসলে আমরা যাদের পাগল বলে জানি, পাগল বলে চিনি, তাদের ধারণক্ষমতা কতটা প্রবল, কতটা শক্তিশালী। ঝুমা পারত নিজেকে সকলের মতো করে একসঙ্গে সংসার করতে কিন্তু করেনি। সে জানত— নিময় মানেই বেড়া, সময় মানেই বয়ে যাওয়া
           তবুও সে আত্মাকে ভাসিয়ে দিতে চায়নি। অবশেষে ঝুমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর সহদেবও বুঝেছিল পৃথিবীর কথা, ভিন্নতা। অবশেষে সে-ও বিড়বিড় করে বলে চলল মধ্যরাত, বলে চলল ভিন্নতা— ‘শুধু পৃথিবীকে পড়ে ফেলার ক্ষমতা যেটা ঝুমার আছে সেটা তাদের নেই বলেই তাকে পাগল ভেবে সরিয়ে রেখেছে যারা, তারা সভ্যতার পাগলামো লুকিয়ে রাখতে ঝুমাদের পাগল বানিয়ে চলেছে ক্রমাগত।’

1 comment:

  1. বা। কিছু বার্তা আসছে শেষপর্যন্ত.. যা এটাকে একটা গল্প করে তোলার সম্ভাবনা রাখল।

    ReplyDelete