এক বসন্তের রাতের ঝড়
শ্যাম পুলক
ক
—স্বপ্নটি তুমি মনে করতে পারছ না? তুমি ভেবেছিলে, সেটা তোমার সৃষ্টি করা
গল্প। আর এখন তুমি স্বপ্নটি মনে করতে পারছ না?
আমি কয়েকবার প্রশ্নের
উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এমনকি আমি
স্বপ্নের মধ্যেও টের পাচ্ছিলাম, আমাকে এই গল্প মনে রাখতে হবে। আর যখন ঘুম ভেঙেছে,
তখন দেখেছি গল্পটি আমার স্পষ্ট মনে আছে। তখন বেশ স্বস্তি নিয়ে আমি আবার ঘুমিয়েছি। এরপর গল্পের পাখি আবার ডানা মেলেছে। জেগে উঠলে
আমি একটি বিশুদ্ধ গল্প নিয়ে দিনভর জেগে থেকেছি। আমি দিনভর নিজেকে বুঝাতে চেয়েছি, এ
স্বপ্ন আমার কোনোভাবেই ভুলে গেলে চলবে না। ফলে গল্পটি আমি নিজের মধ্যে লালন করতে
থেকেছি।
কিন্তু কয়েকবার উত্তর
দেওয়ার পর আমি আগ্রহ হারিয়ে
ফেলেছি। কিন্তু প্রশ্নের সংখ্যা বাড়তে থেকেছে। এবং প্রশ্ন আবার প্রথম থেকে শুরু
হয়েছে। একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তারপর, আমি কেন স্বপ্নটি মনে করতে পারছি
না? কীভাবে এমন সবকিছু ভুলে যেতে পারলাম?
তবে এমন নয় আগে কখনও
এমন ঘটেনি। এমনকি বহু স্বপ্ন আমি ভুলে যেতে পেরেও স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু তারপরও
আমি রাতের একটা অংশ কিচেনে বসে কাটিয়ে দিচ্ছি। অন্ধকারে বসে পোড়া গ্যাসের গন্ধ শুঁকছি।
গন্ধটার প্রতি আমার বেশ আগ্রহ জন্মেছে। তাছাড়া একটা ভ্যাপসা অবস্থা আছে। আছে— ভাতের মাড়ের গন্ধ, মশলার গন্ধ, পচা সবজির গন্ধ। সব মিলে
একাকার হয়ে গেলেও আমি আলাদা আলাদা করে ঘ্রাণ নিতে পারি। আবার যখন আমার নিশ্বাস
ওদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়, তখন আমার
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, চুলায় যুক্ত গ্যাসের পাইপ লিক
হয়েছিল। অথবা আমি যখন গ্যাসের চুলা
অন বা অফ করতে ভুলে যাই, সেটা নিয়ে বেশ অস্বস্তি কাজ করে। তবে আমি যখন বাথরুমে বসে
রাত কাটাই, বাতাস বেশ শান্ত মসৃণ থাকে। জলের ঘ্রাণও বেশ মসৃণ থাকে, যা আমার
স্মৃতিতে গিয়ে আঘাত করে। এমন নয়, আমি ভুলে যাওয়া স্বপ্নটি মনে করতে বদ্ধপরিকর,
কিন্তু আমি সেখানে বসে বসে কারও না কারও সঙ্গে কথা বলতে থাকি। মৃত্যু আমাদের
কথার সবচেয়ে পরিচিত বিষয় থাকে। আমি এই বিষয় নিয়ে কতটা বিরক্ত যে, মৃত্যু চাইতে
শুরু করার পর থেকে পনেরো
বছর চলে গেছে। কিন্তু তারপরও আমি জীবিত। হয়তো মৃত্যুকে আমি চিরকালই বিপন্ন হিসেবে পেয়েছি। এবং একসময় হয়তো তার বিলুপ্তি ঘটেছে। ফলে এখন আর আমার
মৃত্যু সম্ভব না। ফলে এখন আমাকে নিয়ে যা সম্ভব, তা হল একটা নির্দিষ্ট স্থানে বন্দি
করে রাখা— একা ও বিচ্ছিন্ন। তখন আমি
যখন কাউকে জিজ্ঞাসা করি, এমন একা ও বিচ্ছিন্ন থাকার মানে সে বুঝে কিনা, তখন সে
হয়তো প্রশ্ন করে বসে, এটা কি এজন্য যে— এখন আমার আর কোনো আশা নেই?
হ্যাঁ, সে কিন্তু এ
ব্যাপারে সঠিকও। যার মৃত্যু নেই, তার আর কী আশা থাকতে পারে? সে তখন হয়তো বলেছে, তার
মানে সে ঠিকই বুঝতে পারে, আমি কতটা ক্লান্তিকর।— হ্যাঁ। বন্দিত্ব— জেগে
ওঠা, ঘুমিয়ে যাওয়া; আবার জেগে ওঠা, আবার ঘুমিয়ে যাওয়া। কিন্তু সময়কে আমি কীভাবে
অনুবাদ করতে চাইব? প্রশ্ন আসে, ‘তাহলে সময়কে তুমি কীভাবে অনুবাদ করতে চাইবে?’— আমার কানে ফিসফিসিয়ে উচ্চারিত হয়।
আমরা সময়ের বিরদ্ধে
এখন প্রতিশোধ নিতে পারি। তুমি চাইলেই তাকে নিয়ে আপন মনে খেলতে পারো। আমি অনেকবার
ভেবেছি, তাকে ঘুমপাড়ানি গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। ‘কিন্তু সময়কে তুমি কীভাবে অনুবাদ করতে চাইবে?’—আমার কানে ফিসফিসানির
পুনরাবৃত্তি হয়।
মৃত্যুর বিলুপ্তি
ঘটেছে। এখন আমি সময়কে মৃত্যু করে নিতে পারি। হয়তো স্পষ্ট-ই এটা ভান করা হবে। তারপরও
সময়ের অনুবাদ তো হল। ‘হ্যাঁ, সময়কে আমি মৃত্যু হিসেবে অনুবাদ করব।’ তখন মৃত্যুর সঙ্গে
যাপন আরও সত্য হবে। ‘এবং আমি এক জীবন্ত
অস্তিত্ব। কিন্তু আমি দেখব, মৃত্যুকে আমি কতটা উদযাপন করতে পারি, উপভোগ্য করে
তুলতে পারি।’
খ
এক ধরনের পাখির ডাক আমার কানে বাজছে। আমি নিশ্চিত নই, এটা কী পাখির ডাক। হয়তো
পাখিটা কালো রঙের। গায়ে হলুদ রঙের দাগ টানা আছে। যদিও এটা নিছক আমার কল্পনা। আমার
মনে হতে থাকে, তার ডাকে বৃষ্টির গন্ধ মাখা। অবশ্য এমন নয়, বৃষ্টির গন্ধ আমার কাছে
উপভোগ্য মনে হয়। আমি কেবল গন্ধটাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারি। গন্ধটা একটা আশ্চর্য
কাজ করে। একটা ভয়ের মুহূর্তকে
ধীরে ধীরে আমার স্মৃতি থেকে সরিয়ে দেয়। সেটা বৃষ্টির স্মৃতি হোক বা ঝড়ের স্মৃতি।
অবশ্য গন্ধটা সব সময়ই বৃষ্টি বা ঝড়ের
সমাপ্তির পর হালকা বাতাসের সঙ্গে
ছড়ায়।
পাখিটা খোঁজার জন্য
বাইরে যাই না। কিন্তু পাখির ডাক আমার কানে বাজতে থাকে। আমি যতই তাকে সংগীত বলে
মেনে নেই না কেন, তার ভাষা সম্পর্কে আমার ধারণা জন্মে না। যদিও আমি চাইলেই তার ওপর
একটা অর্থ চাপিয়ে দিতেই পারি। যা একান্তই আমার কাছে নিজেকে খুলে ধরবে। তখন আমি
নিজের মতো করে তাকে উদযাপন করব। কিন্তু পাখিটাকে কি কোনোভাবে সেই উদযাপনের সঙ্গী করা সম্ভব? পাখিটা কি
সেখানে নিজের গানের অর্থ খুঁজে পাবে?
শৈশবে গিয়ে পিতাকে
পাওয়া গেলে, তাঁকে এই প্রশ্ন করা যেত। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিতেন। তাঁর সেই আত্মবিশ্বাসের সতেজতা মুহূর্তেই
আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করত। কিন্তু
এখন আমি শৈশবে গেলে তাঁকে সেখানে পাই না। আমি
অবশ্য বুঝতেও পারি, কেন তিনি সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ‘কারণ তুমি তার
স্বপ্নকে খুন করেছ’, ‘কারণ
তুমি নিজেই একটা অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে
জড়িয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছ’
আমি হয়তো দেখতে চেয়েছি, কীভাবে স্বপ্নহীনভাবে তিনি বেঁচে থাকতে পারেন। কীভাবে
পিতৃত্বের খোলস থেকে তিনি বের হয়ে যান। তখন হয়তো তাঁর যৌনতার ইতিহাস ক্ষমতার ক্রমবিকাশের ধারা থেকে বের হয়ে যেতে পারত। অবশ্য আমি নিশ্চিত নই, আমি তাকে কতটা মুক্ত স্বাধীন দেখতে
চাই। ‘সুন্দরের অস্তিত্ব আরও স্পষ্ট হওয়ার মধ্যে হয়তো মুক্তির স্বাদ গ্রহণ সম্ভব
হত’ কিন্তু সুখ নয়, দুঃখ ও সংগ্রামই পিতার জীবনে সবচেয়ে বড় সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
সেখানে সুন্দরের ভাবনায়ও দুঃখ ও সংগ্রামের সৌন্দর্যই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই করুণ
আশ্চর্য সৌন্দর্যের রূপ, আমি সব সময়েই
তাঁর চোখেমুখে অবলোকন করেছি।
যার মধ্যে এক ধরণের ভাঁড়ত্ব আছে, যা তিনি তাঁর পিতা থেকে পেয়েছেন বলে আমি কল্পনা করি। এবং হয়তো তার গভীর থেকে আমি আমার
একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ রচনা করি। ‘কিন্তু সুন্দরের কি কোনো নির্দিষ্ট গঠনতাত্ত্বিক অস্তিত্ব আছে?’
আমি সব সময় ভেবেছি, প্রশ্নের গুরুত্ব কেবল প্রশ্নের মধ্যেই
বর্তমান, উত্তরে নেই। তবে উত্তরটা হল, সেই ছেলেখেলা যা সবাই-ই খেলে, খেলতে হয়। এটা
একই সঙ্গে বন্দিত্ব ও মুক্তি। কিন্তু কোনো প্রাপ্তিই এখানে তেমন অর্থবহন করে না। তবে
প্রশ্নের ভিতরের একটা শক্তি আছে, যা আরও প্রশ্নকে ডেকে আনে। সেই প্রশ্নগুলো আমার
রুমে এসে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার জন্ম দেয়। সবাই বেশ উত্তেজিত। এবং কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
যেমন আমি সব সময় মায়ের ওপর বিরক্ত না হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু
তারপরও বিরক্ত হই। এবং প্রতিবার যখন তাঁর ওপর রেগে চিৎকার করে উঠি, পরে সেটা নিয়ে বেশ অস্বস্তিবোধ করি। বহু বছর
ধরেই তাঁর দিকে যখন তাকাই, বা তাঁর কণ্ঠস্বর যখন শুনি, তখন একটা প্রশ্নই আমি শুনতে পাই। ‘ঠিক কেন আমি তাঁদের মুক্তি দিচ্ছি না?’ আর
আমার চিৎকারে মা যখন ভয় পেতে শুরু করেছে,
তাঁর কান্নারত মুখ আমার জন্য
আরও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। একটা সময় পর থেকে আমি সেই অবস্থাকে ভয় পেতে থাকি। কিন্তু
তিনি তাঁর আশা, অসহায়তা লুকাতে পারেন
না। এবং তাঁর চোখেমুখে, স্বরে একটা স্বপ্ন ভাসতে থাকে— একদিন আমি তাঁদের মুক্তি দেব।
ক্লিওপেট্রাকে মায়ের
ব্যাপারে কী বলতাম তা মনে পড়েছে। ‘মা হল এমন, যে মনে করেন আমাকে সে অনেক ভালোবাসেন। তিনি আমাকে তাঁর গর্ভে দশ মাস রেখেছেন। আমি তার নাড়ি ছেঁড়া ধন। সে আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য। এবং আমি যেহেতু তাঁর থেকে দূরে থাকি, আমাকে তাঁর
খুব মনে পড়ে। ফলে প্রতিদিনই তিনি আমার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর
যেদিন খোঁজ নিতে পারেন না, সেদিন রাতে তিনি ঠিক মতো ঘুমাতে পারেন না।
ঘুমালেও খারাপ স্বপ্ন দেখেন।’ ক্লিওপেট্রা হল সেই মেয়ে যাকে আমি এই নামে ডাকতে
পারতাম। কিন্তু তার সঙ্গে
যোগাযোগ বন্ধ হবার পর মনে হয়েছে, তাকে এই নামে ডাকতে পারতাম।
গ
‘গল্পের ক্ষেত্রে তুমি
জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কারণ দূর অতীতে বিলুপ্ত হওয়া আঁতুরঘরের লজ্জা তুমি এখনও
অনুভব করো।’ আমি ক্লিওপেট্রাকে একবার বলতে চেয়েছিলাম, দেশ জন্মাবার পর তাকে আঁতুরঘরে
ফেলে রাখা হয়েছিল। ‘তাই আজও বিচ্ছিন্নতাবোধ এতটা গভীর।’ ক্লিওপেট্রা বলতে চেয়েছিল,
কারণ তুমি কেবল তোমার আপন একাকিত্বকেই গুরুত্ব দাও। ফলে তোমার নিঃসঙ্গতা যাপন করতে
করতে তুমি নিঃস্ব হয়ে যাও।
কিন্তু আমি এটা দেখেছি
আমার কক্ষে আমার অস্তিত্ব কতটা গাণিতিক। মা আসবেন। ভাই আসবেন। বোন আসবে। কেবল পিতার বর্তমান এখানে উপস্থিতি দেবে না। আমি
গুনে গুনে হিসাব করব, এভাবে বেঁচে থাকা আমার কত বড় অপরাধ হয়ে যাচ্ছে। যখন বন্ধু
আসবে, সে বলবে, কেন আমার গল্প সম্পর্কে মানুষের ধারণাই জন্মাবে না। কেউ বুঝবে না। অথবা
মেনে নিতে পারবে না। এবং যদি আমার কক্ষকে রাষ্ট্র ঘোষণা করি। জনগণ আছে, সার্বভৌমত্ব
আছে। আর কী কী আছে, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভেবে নেবে। তখন আমার গল্প সরকারও মেনে
নিতে পারবে না। তখন পলাতক আসামি থাকবে, নির্বাসন থাকবে, জেল-জরিমানা থাকবে।
ফলে সবার কাজ হল
গল্পকে বিচ্ছিন্ন করে আঁতুড়ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া। তারা বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে
সেটা করবে। কিন্তু তারপরও আমি চেয়েছি গল্প মনে থাক। স্বপ্নটি মনে থাক। তবে এখন টের
পাচ্ছি আর ঠিক উপায় নেই। এবং সবাই যতই আকাঙ্ক্ষা করুক, আমি হয়তো এই স্থবিরতা থেকে
আর কখনওই বের হতে পারব না। ফলে
এমনকি সবার বিস্ময়ের মাঝেও প্রত্যাখ্যান স্পষ্ট হয়।
ঘ
ক্লিওপেট্রাকে বলতে চেয়েছি,
তোমার বেহালাটি দেয়ালে পড়ে আছে। আমার বেহালাটিও আমি ধরছি না। শৈশবে মা কখনও রাতে
ঘুমপাড়ানির গান শুনাননি। দিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যেতেন। ‘দিনভর কাজ করার প্রতি
তার অবসেশন ছিল’, আমি ভাবতাম। মাঝেমাঝে ভাবি, একদিন বেহালা দুইটি আপনাই একসঙ্গে বেজে উঠবে। ধরো, মোজার্টের ভায়োলিন সনাটা— ধীর লয়ে ওরা
একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু আমি জানি
না কী বলছে। ‘তখন তুমি কি
বুঝতে পারছো, ওরা কী বলছে?’ এমনকি হতে পারত ওরা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠছে? যেমন তার্কিশ কনসার্টোতে বেহালা যেভাবে চিৎকার করে ওঠে।
‘তুমি নিশ্চয় জানো, সেই সংগীত বৃষ্টির শব্দে গিয়ে মিশে বজ্রপাতে গিয়ে মিলবে।’
এক রাতে বজ্রপাতের
শব্দে আমার ঘুম ভাঙবে। খেয়াল করব তখনও আমি জেগে আছি। এখানে দৈন্যতা এমন, আমার জেগে
থাকারই কথা থাকবে। ‘তুমি কি
ধরতে পারছ, ঝড়ের অস্তিত্ব কীভাবে আমার অস্তিত্ব হয়ে উঠছে?’ ক্লিওপেট্রাকে প্রশ্ন
করতে পারতাম, আমার অস্তিত্ব কীভাবে ঝড়ের অস্তিত্ব হয়ে উঠছে। সে সময়কে বাঁচিয়ে রাখবে বলে কথা দেয়। ‘তার সময়-গতি সূর্যমূখী’ পাহাড় থেকে মরুভূমি— যেখানে
সে গাণিতিক হিসাবে চলে, সমুদ্রের
জলে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু আমি তাকে বলতে পারতাম, ‘তার চোখে আমি সব দেখতে
চেয়েছি।’ এবং আমার চোখের খাঁচা উন্মুক্ত রেখে বসে থাকি।
দমবন্ধ অবস্থা এখন আর
আমাকে একদম ছেড়ে যায় না। আমি নিজেও যেন ওকে আরও আপন করে নিতে পেরেছি। আমার নিশ্বাস
আর আমার থাকে না। সবকিছুর সঙ্গে
মিশে একাকার হয়েছে। তবে আমি অনেকটা জোর করে ওকে আঁকড়ে ধরে রেখেছি। ব্যাপারটা বেশ
বিস্ময়কর। এটা অবশ্য সময়কে উদযাপনের একটা ভঙ্গি। যেটা আসলে মৃত্যু বলে বয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ‘সবাই হাল ছেড়ে দেবার জন্য মুগ্ধভাবে তাকিয়ে আছে।’
রুমের মধ্যে এক ধরনের ক্লান্তির ছায়া আছে। আসলে তা মৃত্যুরূপী সময়কে আরও
উপভোগ্য করে তুলছে। সেই ক্লান্তিতে অবশ্যই ক্ষুধার ক্লান্তি আছে। আর সেই ক্ষুধা
বলতে গেলে হাজার বছরের। মা কখনওই
এটা মেনে নিতে পারেন না। ইন্টিগ্রেশনের সূত্রগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। এবং মায়ের মেনে
না নিতে পারায়ও ক্লান্তি ভর করে। ‘আমি কি পারতাম না আমার
অর্থহীন স্বপ্ন থেকে একটু দৃষ্টি সরিয়ে নিতে?’ কিন্তু এখন হয়তো ক্ষুধার্তের ভয়ের
অস্বস্তিই আমাকে স্বপ্নকে ভুলে যেতে বাধ্য করেছে। যখন আমি চিৎকার করে বলতে চেয়েছি,
‘আমি ভুলে যেতে চেয়েছি, আমার
ক্ষুধা ও বাধ্যবাধকতা।’ এটা কি এমন, কেবল এজন্যই আমি স্বপ্নে ডুবে যেতে চেয়েছি?
‘কিন্ত এখন! এখন তুমি
কী করবে?’ ভাইবোন বা মায়ের প্রশ্নের উত্তরে আমি আর কিছুই বলতে চাইনি। কিন্তু
ক্লিওপেট্রাকে বলতে পারতাম, ‘দেখো,
মৃত্যু এখন আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। সময়কে আমি আরও স্পষ্টভাবে টুকরো টুকরো করতে
পারছি। এবং তা কেবল তোমাকে আরও স্বার্থপর করে তুলেছে।’
কৈশোরে একসময় আমার
মনে হত, শুধুই কেবল পিতাকে জাগিয়ে রাখছি। যেমন এখন ক্লিওপেট্রার অবস্থান জানার
তেমন প্রয়োজন নেই। সময়কে যখন মৃত্যু বলে অনুবাদ করেছি, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষার আর
প্রয়োজন নেই। মৃত্যুর
বিপন্নতা যেভাবে হতাশ ও জীবনকে অর্থহীন করে তুলত, এখন ক্লিওপেট্রা ঝড়ের
রাত্রিগুলোকে আমার সঙ্গে
সহজেই মিলিয়ে নিতে পারবে। একইসঙ্গে
ধীরে ধীরে আমার অতল অস্তিত্বও কালোতে লুকিয়ে পড়বে। ‘তুমি কি বলছ, ঝড়ের রাত্রি
হারিয়ে যাওয়াটা উন্মোচন করেছে?’
ঙ
সেদিন রাতে আমি গল্পটি নিয়ে
ভাবছিলাম। যে স্বপ্নটি এখন আমি মনে করতে পারছি না। বসন্ত এসেছে, কিন্তু বসন্তের
প্রথম পূর্ণিমা এখনও আসেনি। মাঝরাতে আমি আপনাই জেগে উঠেছি। তখনও ঝড় আসেনি। মনসাকে
নিয়ে ভাবার জন্য জেগে উঠেছি। তার শোক ও ক্ষমতার উদযাপন আমার সঙ্গে আগুনে ঝলসে নিচ্ছে। আগুনের রং কী?— লাল; আগুনের রং কী?— নীল; আগুনের রং কী?— হলুদ;
আগুনের রং কী?— সোনালি; আগুনের রং কী?— ধূসর;... গাণিতিক সূত্রের ব্যাধি এগিয়ে আসে।
আমার পিতাকে মনে
পড়েছে— ঝড়ের রাত্রিতে তাকে জাপটে
ধরে পড়ে থাকা। তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে ধরে রাখতেন। ক্লিওপেট্রাকে তার গল্প বলিনি বললেই চলে। কিন্তু সে বলতে চেয়েছে, ‘তুমি কতটা সচেতনভাবে তার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে
চাচ্ছ?’
আমি তাকে উত্তর
দেইনি। ঝড় স্পষ্ট-ই চিরতরুণ। ‘কিন্তু তার অস্তিত্ব মুছে ফেলা সম্ভব না। তার সীমাহীন আত্মবিশ্বাস খেয়ালি হলেও,
তাই তাকে টিকিয়ে রাখবে।’ ‘অথবা
তার সেই খেয়ালি আত্মবিশ্বাসকে যেভাবে অনুবাদ করা হয়।’ ‘তুমি কি মনে করো না, সেখানেই মনসা জিতেও হেরে যাচ্ছেন?’
তিনি হেরে যাচ্ছেন,
আমাদের মধ্যে এসে। কেবল তার অস্তিত্বে নয়, আমাদের সময়ে। কিন্তু ঝড় ঠিকই তোমার কাছে
গিয়ে অস্তিত্বের জানান দেবে। তুমি যদি তাকে প্রেম হিসেবে অনুবাদ করতে পারো, ততদিন
আমিও দেখব, ভয়কে জয় করে সময় যদি মৃত্যু হয়ও তাকে আমি কতটা উপভোগ্য করে উদযাপন
করেছি।
কিন্তু ঝড়ের মধ্যে
পাখির ডাকের অস্তিত্ব নেই। তবে একটা ঘোর আছে। স্মৃতির ঘোর। ধীরে ধীরে ভীতির স্রোত
বাতাসে জড়িয়ে পড়ে। তখন বাতাসকে আরও ভারী
মনে হয়। এবং আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার আত্মচিৎকার টের পাই। ‘হ্যাঁ, সময়কে আমি
মৃত্যু হিসেবে অনুবাদ করব।’ ক্লিওপেট্রা বলেছে, ঝড়ের রাতগুলো কীভাবে তার জন্য
দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। সাপের হিসহিস ভাষার অনুবাদ আমার জানা নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে
শব্দটা যখন বাড়তে থাকে, আমি চিরন্তন সাপের কামড়ের অপেক্ষায় থাকি। স্পষ্ট-ই সেই
কামড়ের অনুবাদ সময়ের অনুবাদে মিশে যাবে।
এবং একসময় দেখা যাবে,
মাকে ডাকার ভাষাও আমার জানা নেই।
No comments:
Post a Comment