বাক্‌ ১৪৪ ।। প্রাচীনকালের বাংলা ও বাংলায় ব্রাহ্মণদের উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।। হৃষীকেশ বাগচী



আমার নিজের পৈত্রিক পদবী বাগচী। শুনেছি আমরা নাকি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, শান্ডিল্য গোত্র। আমার মামাবাড়ি চক্রবর্তী। তারা রাঢ়ী ব্রাহ্মণ ও ভরদ্বাজ গোত্র। শান্ডিল্য বা ভরদ্বাজ এরা প্রাচীন আর্য ঋষি ছিলেন। তাদের বংশধরেরাই পরবর্তীকালে এমন গোত্র লাভ করেছিল এটা তো নানা সময় শুনেছি। কিন্তু বারেন্দ্র ও রাঢ়ী ব্রাহ্মণ বলতে কি বোঝায়? কিভাবেই বা তাদের উৎপত্তি? এসব জানার চেষ্টা করতে গিয়ে আমাকে পিছিয়ে যেতে হল বহুকাল আগে। বৈদিক যুগের শুরুতে ব্রাহ্মণদের কোনো শ্রেণীবিভাগ ছিল না। পরে তাদের মধ্যে শ্রেণীবিভাজন দেখা দেয়। আর আমাদের বাংলায় এই রাঢ়ী ও বারেন্দ্রদের বিভাজন হয়েছিল তার অনেক পরে। তবে সে আলোচনায় যাবার আগে আমরা বাংলার আদিযুগের অবস্থাটা একটু দেখে নেবার চেষ্টা করি।

আমাদের প্রাচীন বাংলাদেশের যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে আমরা দেখে থাকি প্রাচীন প্রস্তর যুগের পর নব্য প্রস্তর যুগে বাংলায় এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার মূল স্রষ্টা ছিল অস্ট্রিক জাতির লোকেরা। এই আদি অস্ট্রিক জাতি মনে হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ দিয়েই ভারতে প্রবেশ করে। বাংলায় এরা এক কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলে। এরাই বাংলার জমিতে প্রথম ধানের চাষ শুরু করে। আগে মনে করা হত চিন কিংবা বর্তমান তুরস্কের প্রাচীন প্রস্তর যুগের আদিম মানুষেরা প্রথম ধান চাষের শুরু করেছিল। কিন্তু এখন প্রমাণিত হয়েছে যে পৃথিবীর ওইসকল দেশের মত আমাদের ভারতে ও বাংলায় অস্ট্রিকরাও নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতায় ধানচাষ শুরু করে। অস্ট্রিকরাই মনে করা হয় ভারত, মায়ানমার,‌ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে সেখানকার আদিম উপজাতি হিসেবে বসবাস শুরু করেছিল। তাদের থেকেই এরা ‘অস্ট্রিক’ নামে পরিচিত হয়। প্রাচীন ভারতের প্রধানত মধ্য ও পূর্ব অংশে অস্ট্রিকজাতির প্রাধান্য ছিল।

  অস্ট্রিকদের পরে ভারতে আসে দ্রাবিড়রা। এরা ছিল প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার উপজাতি। এরা সীমিত ছিল ভারতে পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে। এরাই সিন্ধু নদের তীরে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় উন্নত নগর সভ্যতার সূচনা করে। এই দ্রাবিড়দের সাথে অস্ট্রিকরা কিছু পরিমাণে মিশ্রিত হয়ে বাংলার আদিম জনজাতির সৃষ্টি করেছিল। আজকেও আমাদের সমগ্র বাংলার লোকাচারে ও ভাষায় অস্ট্রিকজাতির মানুষেরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলার ধান ছাড়াও পান (>বর; বরজ), নারিকেল, লাউ, লেবু, বেগুন, সুপারি, ডুমুর, ডালিম, জাম্বুরা (বাতাপি লেবু), কামরাঙ্গা  এসব এখনও ব্যবহৃত শব্দগুলো সবই অস্ট্রিক ভাষা থেকে এসেছে। এগুলো এখনও আমাদের প্রিয় খাবার। অস্ট্রিকরা আমাদের বাংলায় দ্রাবিড়দের সাথে মিলিত হলেও তারা কিন্তু দ্রাবিড়দের নাগরিক সভ্যতাকে গ্রহণ করতে পারে নি। তাই সিন্ধু নদের তীরে ২৫০০ খ্রীঃপূঃ আশ্চর্যজনক উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠলেও আমাদের বাংলার অস্ট্রিক মানুষেরা তাদের মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালের ঘরেই বসবাস করত এবং গ্রামীণ সভ্যতা তার প্রাণ ছিল। তাই আমরা দেখি ভারতের দুই প্রান্তে একই সাথে দুটি ভিন্নধর্মী সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

  অস্ট্রিকরা ভারতে এসে তামার ব্যবহার শিখেছিল। আমাদের বাংলায় যে পান্ডুরাজার ঢিবি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে তাম্রাশ্মযুগের অস্ত্র, গয়না ও পাত্রের নিদর্শন মেলে। মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলা ছিল তামা উৎপাদনের প্রধান স্থান। তাম্রলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তি (এখনকার তমলুক) নামে যে সমৃদ্ধ নগর ও বন্দর দীর্ঘদিন বাংলার গৌরব হয়ে বিরাজ করেছিল সেই নগরের নামের মধ্যেই তামার ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে। কথিত আছে বাংলার এই তামা এত উৎকৃষ্ট ছিল যে তা মিশরীয়রা তাদের দেশে নিয়ে যেত।

  অস্ট্রিকদের আরেক বিরাট কীর্তি হল তুলার চাষ ও তার ব্যবহার। বাংলায় এরাই প্রথম তুলার চাষ শুরু করে এবং সুতা কেটে কাপড় প্রস্তুত করে। সারা পৃথিবীতে এত উৎকৃষ্ট কাপড় আর কোথাও তৈরি হত না। কর্পাস বা কার্পাস শব্দটিও অস্ট্রিক। পট>পাট>পট্টবস্ত্র, কর্পট>পট্টবস্ত্র এই শব্দদুটি অস্ট্রিক বলে মনে হয়। ‘কম্বল’ শব্দটিও অস্ট্রিক। অস্ট্রিকদের সেই ঐতিহ্য ও পরম্পরা তার পরে হাজার হাজার বছর ধরে বাংলায় বজায় ছিল। ইংরেজরা বাঙালিদের বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করে দেবার আগে পর্যন্ত আমাদের দেশের পট্টবস্ত্র, মসলিন ও সিল্কের কাপড় সারা পৃথিবীর বিস্ময় ছিল।

  আমাদের প্রাচীন বাংলার আরেক আশ্চর্য ছিল হাতি। এই হাতি নিয়ে সিন্ধুসভ্যতার লোকেরাও এত উৎসাহিত ছিল যে তাদের প্রচুল সীল ও তামার ফলকে হাতির ছবি দেখতে পাই। তবে এই হাতির প্রধান আবাসভূমি অস্ট্রিক অধ্যুষিত আমাদের বাংলা হলেও তারা মনে হয় তখনও হাতিকে পোষ মানাতে শেখে নি। সংস্কৃত ‘গজ’, ‘মাতঙ্গ’ এমনকি ‘হাতি’ শব্দটিও মনে হয় অস্ট্রিক ভাষা থেকে এসেছে। এরা গুঁড়ি কাঠের তৈরি ডিঙ্গা প্রস্তুত করে সমুদ্রে দূরে দূরে পারি দিত এমন কথাও ঐতিহাসিকেরা বলে গেছেন। ‘ডোঙ্গা বা ‘ডিঙ্গা’ শব্দটিও অস্ট্রিক। তারা পলিনশীয় ও মেলানেশীয় অঞ্চলের লোকেদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে।

  এই অস্ট্রিকদের উত্তরসূরী হল আজকের কোল, সাঁওতাল, লোধা জাতিরা। আমাদের আধুনিক বাঙালি তাই ব্রাহ্মণই হোক বা কায়স্থ প্রত্যেকের জীবনযাত্রায় এদের প্রভাব নিরন্তর জড়িয়ে আছে। আমাদের আজকের বিবাহ আচারের গায়ে হলুদ, সপ্তপদীগমন, সিন্দুর দান ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এইসব নানা প্রথা পরবর্তীকালে আর্যরা অস্ট্রিকদের থেকেই গ্রহণ করেছিল।

  আনুমানিক ১৫০০ খ্রীঃপূঃ মধ্য এশিয়ার স্তেপি অঞ্চল থেকে আর্যদের এক গোষ্ঠী যখন হিন্দুকুশ অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করল তখন সেই যাযাবর রথচালকদের প্রভাবে নাকি সরস্বতী নদী গতিপথ পালটে ফেলায় সিন্ধুসভ্যতার লোকেরা দক্ষিণে সরে দক্ষিণে দ্রাবিড় সভ্যতার পত্তন ঘটাল তা আমরা কেউ সঠিকভাবে জানি না। তবে তারপর হাজার বছর ধরে উত্তরভারতে আর্যসভ্যতা বিস্তারের সময় বাংলার অস্ট্রিকজাতিরা কিন্তু তাদের স্বাতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিল।

  ঐতিহাসিক যেসব বিবরণ পাই তা থেকে মনে হয় তখন বাংলা অনেকগুলো ছোট ছোট কৌমে বিভক্ত ছিল। তাদের নাম ছিল পুন্ড্র, রাঢ়া, বঙ্গ, সুহ্ম ইত্যাদি। ঋক্‌সংসিতায় আমরা বঙ্গদেশের নাম পাই না। সেখানে ‘কীকট’ দেশের (বর্তমান গয়া) নাম পাই। আদি বৈদিক আর্যগণের বসবাস ছিল সরস্বতী ও দৃষদ্বতী নদীর মাঝের দোয়াব অঞ্চলে। তারা সেই অঞ্চলকে বলত ব্রহ্মবৈবর্ত। এই অঞ্চলে যে ব্রাহ্মণেরা বসবাস করত তারা পরিচিত হয় ‘সারস্বত ব্রাহ্মণ’ নামে। ঐতরেও ব্রাহ্মণে আমরা প্রথম বঙ্গের নাম পাই। এখানে আমাদের ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষীজাতীয়’ বলা হয়েছে। তাই মনে হয় ওইসময় বাংলায় বসবাসকারী কোনো কৌমের টোটেম ছিল ‘পাখি’। আবার অনেকে বলেন আর্যরা অস্ট্রিক ভাষা একেবারেই বুঝতে পারত না। তাদের কাছে তাকে পাখির ডাকের মত শোনাত। তাই তাদের এমন নামে সূচিত করা হয়েছিল। বিশ্বামিত্রের পুত্র ছিলেন পুন্ড্র। তার নাম থেকেই বাংলায় পুন্ড্র বা পৌন্ড্র দেশের উৎপত্তি বলে অনেকে বলেন। আর্যরা পুন্ড্রদের ‘দস্যু’ বলে বর্ণনা করেছিল। মনুসংহিতায় বলা হয়েছিল তীর্থযাত্রা ছাড়া বঙ্গদেশে গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এর থেকে আর্যদের যেমন বঙ্গদেশের লোকের প্রতি ঘৃণার পরিচয় পাই তেমনি আমরা একথাও বুঝতে পারি যে বঙ্গদেশে কিছু উল্লেখযোগ্য তীর্থ তখনও ছিল এবং তাতে যাওয়া নিষেধ ছিল না।

  জৈন ধর্মগ্রন্থেও প্রাচ্যদেশের নিন্দা করা হয়েছিলযদিও জৈনধর্মই ছিল আমাদের বঙ্গদেশের আদিতম ধর্ম। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের জন্য ভীম যখন সমুদ্র তীরবর্তী বঙ্গের রাজাদের পরাজিত করেন তখন তাদের ‘ম্লেচ্ছ’ বলে অভিহিত করা হয়। আর্যমঞ্জুশ্রীকল্পে আদি বঙ্গের ভাষাকে বলা হয়েছে ‘অসুর ভাষা’। আমরা এখন জেনেছি আর্য ও অসুরেরা একই অঞ্চল থেকে বিবাদের জন্য বিভাজিত হয়ে যায়। তাদের বিবাদের মূল কারণ ছিল আরাধ্য দেবতা। তারা অসুরদের শত্রু বলেই মনে করত। অসুরদের ওপর সেই পুরনো রাগ তারা সম্ভবত উগড়ে দিয়েছিল প্রাচীন বঙ্গের জনজাতির ওপর।

  তবে আর্যরা কিন্তু দীর্ঘদিন এই বাংলার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে নি। উন্নত অস্ট্রিক সভ্যতা ও তার সমৃদ্ধি দেখে আর্যরা তাদের সাম্রাজ্য পূর্বে বিস্তার করা শুরু করে। তবে আমার মনে হয় প্রথমে তা যত না যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে দিয়ে হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে বৈশ্য শ্রেণী এবং জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে। বাংলার জল হাওয়াই এমন তা সব প্রকার সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে নেয়নর্ডিক আর্য জনজাতির মানুষ ধীরে ধীরে এভাবেই প্রাচীন বঙ্গের মানুষ যারা কিনা মূলত ছিল অস্ট্রিক ও আংশিক দ্রাবিড় এবং অতি সামান্য নেগ্রিটো রক্তের তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাংলায় মিশ্র এক জনজাতির সৃষ্টি করল। আমরা আজকের যারা বাঙালি তারা মনে হয় সেই মিশ্র জাতির সংশ্লেষ থেকেই এসেছি।

  আর্যদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ছিল খুব কম তাই প্রথমে একই পরিবারের দাদা ও ভাই একই নারীকে বিবাহ করত। ‘দেবর’ বা দ্বিতীয় বর এই বৈদিক শব্দের মধ্যেই সেই ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনে তারা অনার্য বা ম্লেচ্ছ জনজাতির সাথে মিশ্রিত হয়। তাদের চতুবর্ণ প্রথা এই প্রাচীন বাংলাতেও ধীরে ধীরে চালু হয়ে যায়। খ্রীঃপূঃ ৩০০ শতকে মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত পুন্ড্রনগরে এক শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু তখনও বাংলার বেশিরভাগ অংশই ছিল স্বাধীন। ৫০০ খ্রীঃ গুপ্তযুগে বঙ্গদেশ আর্যাবর্তের অধীন হয়। এই দীর্ঘ আটশ বছর ধরে বঙ্গদেশে আর্যায়ন চলেছিল।

  তখন সেই প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী নগরী ছিল গৌড়। অনেকে বলেন এই অঞ্চলে আখের খুব চাষ হত। তা থেকে তৈরি হত গুড়। গুড় থেকেই ‘গৌড়’ নামের উৎপত্তি। এই গৌড় আর্যায়নের আগেই বিখ্যাত নগরী ছিল এবং আর্যরা তার সম্পর্কে অবহিত ছিল। পাণিনি খ্রীঃপূঃ ৫০০ অব্দের লোক বলে মনে হয়। তার ‘অষ্টাধ্যায়ী’ তে তিনি গৌড়ের উল্লেখ করেছেন। খ্রীঃপূঃ ৩০০ অব্দে রচিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আমরা গৌড়ের উল্লেখ পাই। বাংলার হাতি, বস্ত্র ও রেশমের বর্ণনা পাই। আলেকজান্ডার যখন ৩৪৬ খ্রীঃপূঃ ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন তখন কথিত আছে তিনি বঙ্গের ‘গঙ্গারিডি’ নামে এক জাতির পরাক্রমের কথা শুনে ও তাদের বিরাট হাতিবাহিনীর কথা শুনে আর অগ্রসর হতে সাহস করেন নি। এই কথা প্লিনি, ডিওডোরাস, টলেমি সব ঐতিহাসিকেরাই বলে গেছেন। বাংলার নগর গৌড় পরবর্তীকালে এতই সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে যে আমরা দেখব পাঠান শাসকেরাও বাংলায় এসে বাংলা শাসন করার সময় নিজেদের ‘গৌড়েশ্বর’ বলেই পরিচয় দিতেন।

  বাংলায় আর্যায়ন সম্পূর্ণ হলে যারা আর্যদের সাথে মিশে গেল তারাই হল আধুনিক বাংলার আদি জনক। আর যারা তাদের স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে অরণ্যচারী হল তারা আজকের কোল, সাঁওতাল, লোধা জাতি হয়ে টিঁকে রইল। আর্যরা আসার পরে তাদের বিখ্যাত বা কুখ্যাত চতুবর্ণ প্রথা বাংলায় চালু হল এ কথা আমরা আগেই বলেছি। এখন আমরা সেই চার শ্রেণীর মধ্যে ব্রাহ্মণদের কথাই এখানে আলোচনা করব। আমরা কিন্তু বর্ণের পরিবর্তে শ্রেণী কথাটাই ব্যবহার করলাম।

  সরস্বতী নদীর তীরে বসবাসকারী আদি বৈদিক ব্রাহ্মণেরা নিজেদের সারস্বত বলে পরিচয় দিত। বাংলায় সেই সারস্বত ব্রাহ্মণদের কিছু গোষ্ঠী তখন এসেছিল ও বসবাস শুরু করে। এখনকার বাংলায় আমরা সেই ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীকে খুঁজে পাই না। তবে এখনও বাংলার মত ভারতের অন্য রাজ্যেও আমরা ‘গৌড়ীয় ব্রাহ্মণ’ বলে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের পরিচয় পাই। তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি আছে দিল্লিতে, বেশ কিছু সংখ্যক বাংলা ছাড়াও আছে দাক্ষিণাত্যে। এরা বলেন এরা মূলত বাংলার গৌড়ের আদি ব্রাহ্মণ। জনমেজয়ের সর্পসূত্র যজ্ঞ করার সময় এরা বাংলা থেকে হস্তিনাপুর বা অধুনা দিল্লিতে যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। তাহলে আমরা দেখছি সেই আর্যায়নের কালে যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ শ্রেণীর উৎপত্তি হয়েছিল তাদের কিছু ছাপ আমরা খুঁজে পাচ্ছি সেই সারস্বত ব্রাহ্মণ বা গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে।

  আরেক শ্রেণীর আদি ব্রাহ্মণ সমাজের পরিচয় আমরা পাই যাদের বলা হয় সপ্তশতী। এই সপ্তশতী ব্রাহ্মণ কারা আর কারাই বা বারেন্দ্র ও রাঢ়ী ব্রাহ্মণ? তা আমরা অবশ্যই আলোচনা করব। কিন্তু এই প্রসঙ্গে একটা কথা আমি আমার পাঠকদের খুব খোলাখুলি জানিয়ে রাখি যে আমি ঐতিহাসিক নইতাই ঐতিহাসিকের বৈজ্ঞানিকতা যেমন আমার নেই তেমনই নেই নির্লিপ্ততাআমি জনশ্রুতিকে মান্য বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি লোকাচার, লোককথা বা লোকসংস্কৃতি ইতিহাস পাঠের উল্লেখযোগ্য উপাদান হয়ে উঠতে পারেএটা আমার দূর্বলতা বা জ্ঞানের খাদ হতে পারে কিন্তু আমি যা বিশ্বাস করি তা নিয়ে অকপট হতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। তাই ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তার বিখ্যাত বই ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এ আদিশূরের লোকশ্রুতিকে অবজ্ঞা করলেও আমি নগেন্দ্রনাথ বসুর মতই তাকে মান্য বলে মনে করিতাই উপরের তিন ব্রাহ্মণদের উৎস জানাতে হলে আমাকে সামন্তরাজা আদিশূরের মিথ বলতেই হবে।

  তবে আদিশূরের আগে বাংলার যে পরাক্রমশালী রাজার নাম না বললেই নয় তিনি গৌড়রাজ শশাঙ্ক। আনুমানিক ৬০৬-৬০৭ খ্রীঃ কিছু আগে তিনি বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ বা বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটির নিকট কানসোনায়। তিনি ছিলেন শৈব। ইতিহাসে তাকে ‘বৌদ্ধবিদ্বেষী’ বলে দেখানো হয়েছে। এই অপবাদ মূলত প্রচার করেছেন চৈনিক পর্যটক য়োয়ান চোয়াং এবং ‘মঞ্জুশ্রীমূলকল্পের’ গ্রন্থকারেরা। কথাটা মিথ্যেও ছিল না। তিনি বহু বৌদ্ধ মঠ ও স্তূপ ধ্বংস করেনএই বিদ্বেষের এক প্রধান কারণ ছিল তিনি যেহেতু শৈব ছিলেন তাই তখন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের বাড়বাড়ন্ত রোধ করাই তিনি সঙ্গত বোধ করেন। আরেকটা কারণ অবশ্যই ছিল থানেশ্বরের রাজা বৌদ্ধ হর্ষবর্ধনের সাথে তার আমৃত্যু বৈরিতা।

  এই শশাঙ্কের সম্পর্কে এক জনশ্রুতি আছে যে একবার তিনি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। তখন সেই রোগ থেকে মুক্তিলাভ করতে তিনি সরযূ নদীর তীর থেকে কয়েকজন ব্রাহ্মণকে যজ্ঞের জন্য বাংলায় নিয়ে আসেন ও তাদের আশ্রয় দেন। নদীয়ার বঙ্গসমাজের কুলজী গ্রন্থে এই কথা লেখা আছে। সুতরাং বাংলা থেকে ব্রাহ্মণেরা যেমন রাজাদের আমন্ত্রণে বাইরে গেছেন তেমনি বাংলার বাইরে থেকেও সাগ্নিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় আগমন স্বাভাবিক ছিল।
গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে সারা বাংলায় মাৎস্যন্যায়ের সৃষ্টি হয়। এই অরাজকতা দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল। বাংলায় এসময় কোনো শক্তিশালী রাজা না থাকায় অনেক সামন্তরাজারা বিচ্ছিন্নভাবে নানা স্থানে রাজত্ব করতেন। কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে আছে কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য এইসময় গৌড় আক্রমণ করেন ও শঠতার সঙ্গে গৌড়রাজকে হত্যা করেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে কান্যকুব্জ বা কনৌজ বা কাশীতে রাজা যশোবর্মা বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি খুব সদাচারী ও ধর্মানুরাগী রাজা ছিলেন বলে শোনা যায়। বাংলায় এসময় জয়ন্ত বলে এক সামন্ত রাজা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন ও আদিশূর নাম নিয়ে তিনি বাংলায় রাজত্ব করতে শুরু করেন। বাংলায় এসময় যে ব্রাহ্মণেরা ছিলেন তারা অনেকেই পতিত হয়েছিল। অনেকেই বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের বেদ পাঠের অধিকারও ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটা কথা জেনে রাখা ভাল যে বৈদিক যুগে বা তার পরবর্তী এই সময়ে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারোর বেদপাঠেরও অধিকার ছিল না। যদিও আমরা জাবাল সত্যকাম ও ঋষি গৌতমের উদাহরণে জানি কোনো পতিত জাতির মানুষও নিজস্ব গুণে ব্রাহ্মণ্যত্ব অর্জন করতে পারত কিন্তু তার উদাহরণ খুব বেশি ছিল বলে মনে হয় না। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে আবার বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃতির ফলে এই ব্রাহ্মণেরা পতিত হয় এবং বেদপাঠ এবং যাগযজ্ঞের অধিকার হারায়।

  আদিশূর অপুত্রক ছিলেন। তাই তিনি পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ করার জন্য রাজা যশোবর্মাকে পাঁচজন বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ গৌড়ে পাঠাতে অনুরোধ করেন। বঙ্গদেশ তখনও মনে হয় তার আর্যাবর্তের কাছে তার ‘অচ্ছুত’ তকমা হারায় নি। তাই আদিশূর ‘ম্লেচ্ছ’ দেশে ব্রাহ্মণ পাঠাতে অস্বীকৃত হন। তখন আদিশূর তার সেনাপতি বীরবাহুকে কনৌজ রাজ্য জয় করতে পাঠান। কিন্তু শক্তিশালী কনৌজরাজ সহজেই তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন। আদিশূর এতে না দমে তার অনুগত হেরম্বরাজকে সেনা পাঠাতে বলেন। হেরম্বরাজ বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি জানতেন সরাসরি কনৌজকে হারানো অসম্ভব। তাই তিনি ছলনার আশ্রয় নিলেন। সাতশ জন পতিত ব্রাহ্মণকে গরুর পিঠে বসিয়ে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে পাঠালেন। ব্রাহ্মণ ও গোহত্যার পাপ থেকে রক্ষা পেতে কনৌজরাজ সন্ধি করলেন এবং পাঁচজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ ও তার সাথে পাঁচজন উচ্চ কায়স্থকে গৌড়ে পাঠালেনএই পাঁচজন ব্রাহ্মণের মধ্যে শান্ডিল্য গোত্রের ভট্টনারায়ণ, কাশ্যপ গোত্রের সুষেন, বাৎস্য গোত্রের ধরাধর, সাবর্ণ গোত্রের পরাশর এবং ভরদ্বাজ গোত্রের গৌতম এই পাঁচজন ব্রাহ্মণ গৌড়ে আসেন। আদিশূর খুশি হয়ে সেই সাতশজন ব্রাহ্মণকে ‘সপ্তশতী’ বা ‘সাতশতী’ নামে সম্মানিত করেন।
  পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞ সম্পন্ন করে পাঁচ ব্রাহ্মণ কনৌজে ফিরে যান। কিন্তু মগধ হয়ে কনৌজে ফিরেছিলেন বলে সেখানকার ব্রাহ্মণেরা বলেন তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে নইলে তারা সমাজে গৃহিত হবেন না। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা এতে অপমানিত হন এবং পুনরায় গৌড়ে ফিরে যান। গৌড়ে ফিরে এলে আদিশূর তাদের সম্মানের সাথে পাঁচজনকে পাঁচটি গ্রাম দেন। যে সাতশজন ব্রাহ্মণ গরুর পিঠে বসে যুদ্ধে গেছিলেন তাদের তিনি ‘সপ্তশতী’ ব্রাহ্মণ এই অভিধায় সম্মানিত করেন এ কথা আগেই বলেছিকনৌজের সাগ্নিক পাঁচ ব্রাহ্মণ এই সপ্তশতী ব্রাহ্মণদের বা বঙ্গের আদি ব্রাহ্মণদের মেয়েকে বিয়ে করে গঙ্গার ডানতীরের সমৃদ্ধ রাঢ়দেশে বসবাস করতে শুরু করেন। এদের বংশধরেরাই ক্রমে ‘রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত হয়। যে পাঁচটি গ্রামে তারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তা হলঃ ব্রহ্মপুর(মালদা), হরিকোটি>হরিপুর, কঙ্কগ্রাম>কাঁকড়ি, বটগ্রাম>বটরিয়া>বটরী(মালদা), কামকাটি>কামট (গঙ্গাবক্ষে বিলীন বলে অনুমিত)। এই পাঁচ কনৌজজাত ব্রাহ্মণদের থেকেই বাংলার সব রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।

  এদিকে কনৌজের ব্রাহ্মণরা ফিরে না আসায় তাদের বংশধরেরা তাদের শ্রাদ্ধশান্তি করলেন। কিন্তু প্রতিবেশি কোনো ব্রাহ্মণ পিণ্ড গ্রহণ না করায় তারা গৌড়ে ফিরে আসেন। আদিশূর তাদের রাঢ়ে বসবাস করতে বললে বিমাতার সাথে থাকতে অস্বীকৃত হলে তাদের গঙ্গার বামতীরের উচ্চ বরেন্দ্রভূমিতে বসবাসের অনুমতি দেন। এদের উত্তরপুরুষরাই পরবর্তীকালে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বলে পরিচিতি লাভ করেন।

  আদিশূরের মৃত্যুর পরে তার ছেলে ভূশূর রাজা হলেন। কিন্তু এইসময় মগধের রাজা ধর্মপাল পৌন্ড্রবর্ধন দখল করেন। ভূশূর রাঢ়দেশে পালিয়ে যান এবং সেখানে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। পরে পাল বংশীয় বৌদ্ধ রাজারা প্রায় চারশ বছর বাংলায় শাসন করেন। তারা বৌদ্ধ হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। তাই বাংলার ব্রাহ্মণেরা তাদের পরিচয় পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে নি। যদিও শাসকের অনুগামী হয়ে এই সুদীর্ঘ চারশ বছরে অনেকেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পালেরা উত্তর রাঢ় অধিকার করলেও দক্ষিণ রাঢ় সহজে অধিকার করতে পারে নি। সেখানকার রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণেরা দীর্ঘদিন পাল রাজশক্তিকে প্রতিহত করে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিল।

  ভূশূরের পুত্র ক্ষিতিশূর তার প্রপৌত্র ধরাশূর, তারও দুই পুরুষ পরের শূর বংশের মেয়ে বিলাসদেবীর সাথে দাক্ষিণাত্যে কর্নাটক রাজ্যের সামন্তরাজা বিজয়সেনের বিবাহ হয়। তাদের পুত্রের নাম বল্লালসেন। বল্লালসেন (১১৫৯-৭৯) বাংলায় সেন বংশের  প্রথম অন্যতম রাজা। এই সেন বংশীয়রা কর্ণাটক থেকে বাংলায় এসে দীর্ঘদিন বসবাস করছিল। মনে হয় এরা কর্ণাটকের কোনো সামন্ত রাজা ছিলেন বাংলায় চোল আক্রমণের সময় তারা রাজেন্দ্রচোলের সেনাবাহিনীর সাথে বাংলায় এসে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। পাল সাম্রাজ্যের পতনে এরাই বাংলায় সেন বংশের সূচনা করেন। সেনরা মনে হয় আগে ব্রাহ্মণ ছিল পরে ক্ষত্রিয় হয়। তারা নিজেদের ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ বলে পরিচয় দিত। এই সেনরাজারা অত্যন্ত ব্রাহ্মণ অনুরাগী ছিলেন বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের প্রচুর ধনসম্পদ বিতরণ করেন। কথিত আছে সেই ব্রাহ্মণ পত্নীদের অন্য নাগরিক পত্নীরা মুক্তা, মরকত, মণি, রূপো, রত্ন ও সোনার সাথে কার্পাস বীজ, শাকপাতা, লাউয়ের ফুল, ডালিমের বীচি ও কুমড়োর বীচির পার্থক্য বোঝাতেন।

বল্লাল রাজা হয়ে দেখলেন আবার সেই বাংলার ব্রাহ্মণেরা দীর্ঘ চারশ বছরের বৌদ্ধ রাজবংশের প্রভাবে পতিত হয়েছেন। তাই তিনি আবার ব্রাহ্মণ সংস্কারে মন দিলেন। কথিত আছে তিনি প্রাত্যহিক নিত্যকর্ম করার পর কয়েকজন নির্বাচিত ব্রাহ্মণ শ্রেণীর প্রতিনিধিদের তার সাথে দেখা করতে বললেন। উদ্দেশ্য ছিল যারা প্রথমে আসবে তারা নিশ্চই নিত্যকর্ম পদ্ধতি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেন না। কারণ তাতে সময় কম লেগেছে। তাই যারা এক প্রহর ও দেড় প্রহরে এল তাদের তিনি ‘গৌণ কুলীন’ ও যারা আড়াই প্রহরের পর দেখা করতে এলেন তাদের ‘মুখ্য কুলীন’ নামে পরিচিত করলেন। এভাবেই ৮টি মুখ্য কুলীন ও ১৪টি  গৌণ কুলীন ব্রাহ্মণ নির্বাচিত হলেন। এই ২২ জনকে তিনি ২২ খানি গ্রাম দিলেন। এরা তাদের গ্রাম বা ‘গাঙি’ পরিচয়ে পরিচিত হল। কুলীন ব্রাহ্মণেরা অন্য কুলীন বা অকুলীন বংশের মেয়েদের বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু কুলীন কন্যারা কিছুতেই অকুলীন পাত্র স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন না। এই ‘বল্লালী বালাই’-এ মধ্যযুগের বঙ্গ কুলীন ব্রাহ্মণসমাজ অনেক নীচে নেমে যায়। রামনারায়ণ তর্করত্ন তার ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে এই লোভী ব্রাহ্মণদের ‘বিবাহবণিক’ নামে অভিহিত করেন। বিদ্যাসাগর মশাই ও রামনারায়ণ এই প্রথা রদ করতে প্রচুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সফল হতে পারেন নি। তবে তাঁদের উদ্যোগেই বাংলায় চতুর্দশ শতকে এই কুপ্রথা বিলুপ্ত হয়।

  আমি আগেই বলেছি ঐতিহাসিকেরা যেমন নীহাররঞ্জন রায় প্রমূখ অনেকেই এই ‘আদিশূরের মিথ’ যা কিনা বিভিন্ন কুলুজীকারদের পুঁথিতে লেখা আছে তাকে মান্যতা দিতে চান না। তবে নীহাররঞ্জন তার ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে বলেছেন ব্রাহ্মণেরা যে তাদের গ্রাম বা ‘গাঙি’র পরিচয়ে পরিচিত হতেন তা মিথ্যে নাও হতে পারে। তাঁর মতে রাঢ় এবং বরেন্দ্রভূমিতে বংশানুক্রমে বসবাসকারী ব্রাহ্মণেরাই ‘রাঢ়ী’ বা ‘বারেন্দ্র’ বলে পরিচিত হন। তিনি আরও বলেছেন আগে বাংলার ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রচলিত পদবীর মধ্যে ‘শর্মা’ ও ‘স্বামী’ পদবীই প্রধান ছিল। পরে নানান পদবী আসে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাঢ়ী পদবী মুখোপাধায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায় হতে পারে তাদের ‘গাঙি’কে সূচিত করছে। উদাহরণসরূপ বলা যায় ‘মুখুটি’ গ্রামের রাঢ়ী ব্রাহ্মণ পরিচিত হন মুখোপাধায় পদবীতে। অনেকে মনে করেন মুখোপাধায় থেকে ‘মুখার্জি’ বা সাহেবি কেতায় ‘মুকুর্জি’ বোধ হয় ইংরেজদের দেয়া নাম। পলাশ বরণ পাল তার ‘হক কথা’ বইয়ে বলেছেন, ‘মুখুটি’ বা ‘মুকুটি’ গ্রামের কুলীন ব্রাহ্মণ সম্মানিত ছিলেন বলে তাকে ‘জি’ বলা হত। তার থেকেই ‘মুখার্জি’। তবে এই ‘জি’ অনুসর্গটি পশ্চিম ভারতীয় বলে এর বাঙ্গালিকরণ করা হয় সংস্কৃত ‘উপাধ্যায়’ যুক্ত করে। তাই মুখার্জি বা মুখুজ্জে থেকে পরে এসেছে ‘মুখোপাধ্যায়’। অন্য প্রধান তিনটি রাঢ়ী পদবী নিয়েও একই কথা বলা যায়। বন্দ্যোঘটি, চাটুতি, গাঙ্গুর বা গঙ্গ গ্রাম থেকে বাকি তিনটি রাঢ়ী পদবী এসেছে। সুতরাং আমরা দেখলাম মুখার্জি কিন্তু মুখোপাধ্যায় অপেক্ষা প্রাচীনতর। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় উপরোক্ত চারটি পদবীর অধিকারীরাই কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ বলে বিবেচিত হত। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ঊনষাটটি পদবী আগে প্রচলিত ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি টিকে আছে। বাকিরা অন্য পদবীতে বিলীন হয়ে গেছে বলেই মনে হয়।

  অনুরূপভাবে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের একশটি ‘গাঙি’ বা গ্রামসূচক পদবী ছিল। তার মধ্যে বাকচি/বাগচি/বাগচী, লাহিড়ি, মৈত্র, ভাদুড়ি ও সান্যাল এই কয়েকটিই মাত্র আজকে টিকে আছে।

  বাঙালি ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘গাঙি’ নামে পদবী হলেও পরে জীবিকা অনুসারেও পদবী হয়। যেমন ভট্ট (বংশ পরিচয়দাতা), ভট্টাচার্য ( ভট্ট+আচার্য, পন্ডিত), ঘটক (ঘটকালি করা), পাণ্ডা (পূজারী), শাস্ত্রী (শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি), পাঠক (বেদ পুরাণ পাঠ করতেন যারা, প্রাচীন ভারতীয় ‘সৌতি’?) –এদের নাম উল্লেখ করা যায়।

  এভাবেই আমরা দেখলাম প্রাকবৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি আমরা বাঙালি জাতি বিশেষ করে বাঙালি ব্রাহ্মণেরা বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছিকত রূপান্তর, কত জৈন বৌদ্ধ প্রভাবের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজকের বাঙালি ব্রাহ্মণ। আমাদের মধ্যে কতই না পাপের অভিশাপ লেগে আছে। বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পাপ, লোভ আমাদের পরতে পরতে জড়িয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেসব এখন কোথায়? আজ সেই আদিশুরও নেই নেই তার মেঘনা নদীর পূর্বপারের বিক্রমপুরের রামপাল গ্রাম, যার এক গজারি (একধরনের প্রায় বিলুপ্ত শালের প্রজাতি) গাছের নীচে তিনি পাঁচ ব্রাহ্মণকে পাঁচটি ‘গাঙি’ দান করেছিলেন বলে লোকশ্রুতি আছেইতিহাস ক্রমে ক্ষয়িত হয়ে যায়। লোককথার মাধ্যমে অনেক ইতিহাস বিকৃত হয়েও বহুবছর জীবিত থাকতে পারে। ইতিহাসের চলন একমুখী। সে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলে। আর পেছনে রেখে যায় তার লিগাসি। সেই লিগাসির সরূপ সন্ধান করতে গিয়ে আমরা বিভ্রান্ত হই, তর্ক করি, বিতণ্ডা হয় পন্ডিতে পন্ডিতে। সে শুধু মুচকি হাসে। তার চলার তো শেষ নেই। তাই তার বৃত্তান্ত বর্ণনাও শেষ হয় না। আর শেষ নেই যার তার শেষ কথাটি কেই বা বলতে পারে।



[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত সকল মতামত ও তথ্যভাণ্ডার লেখকের নিজস্ব ও ব্যক্তিগত উদ্ধার। সম্পাদকের মতামতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক বিষয়েই সম্পাদক ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। অনুপম]







2 comments: