অনন্ত নক্ষত্রবীথি
...
দীপ সাউ
যখের ধন
গাছকে আলিঙ্গন করার পর প্রস্তুতি সদনে যেতে হয়,
বাঘ যখন আসে বোঁটকা গন্ধ নৈঃশব্দ্য, বাতাসে পাতা ঝরে
খাসিয়া পাহাড়ে নরভূক হলুদ নারীরা উলুধ্বনি দেয়,
জাল মরার মাথা আমার হাতে— সর্বনাশ ডাকে,
গুহায় কিছু থাকে না— রহস্যময়তা আলো অন্ধকার
তবু নিশি ডাকে
আবার যখের ধন
ভেজালো বাতাসে রহস্যের খোঁজ— লোকেরা বিমনা
যদিও সমুদ্র প্রগাঢ় জলে ঢেউ ওঠে— খুব নোনা;
ভয়, অত্যাচার, রক্তপাত কিছুই ঠেকাতে পারে না। না বুঝে
রোদ শুধু মরে যায়— পুবে জানলা থেকে পশ্চিম উঠোনে
পাখা ওড়ে, ঝরে।
নদীপাড়ে শেষ নৌকো, আকাশ বিছিয়ে রাত নামে
ধু ধু বালি, বন সময় ফুরিয়ে যায়।
কাকসিরিজ
(কবি শংকর চট্টোপাধ্যায়কে)
আক্রান্ত
স্ত্রী কাকের ছলকলা প্রণয়ভঙ্গি— এসব দেখে ক্লান্ত কাক
উড়ে যায় শিশুর রূপসী পৃথিবীতে— জোনাকিরা পাতার পেছনে চুপ।
শিকারের দু-একটা পালক ঘাসের শিশিরে ক্রমশ ভারী।
ক্লান্ত কাক এসব নিয়ে একটা জগৎ গড়ে তোলে।
সংগমের লোভে কাক শুধু শীর্ণ হয়; শ্রান্ত হয়
আর দেখে ছিট কোকিল আকাশ থেকে উড়ে আসে
নিঃসঙ্গ বাসার দিকে।
বাসা
কাকের নির্মাণ কুশলতা দেখে সব তালি দেয়,
কটা অপলকা কাঠির মায়াবী বিস্তার,
পালকের রোম, আত্মশ্লাঘা
বাতাসে দোলে, তির্যক রোদে তৃপ্ত হয়
হেমন্তের শিশিরে ভিজে একসা
তবু,
লুন্ধ চোখে দেখে কোকিল, আত্মপ্রত্যয়, খড়কুঠো।
অনিশ্চিত
রান্নাঘরের শূন্যতা ভালোবাসে, ডোরাকাটা জানলা
খাবার টেবিলে মাখনমাখা বিস্কুট, সিদ্ধ ডিম,
শিশুর ডিমসাদা মুখ।
শত্রু শুধু ধূর্ত বিড়াল, কাঁটা আক্রোশ,
নরম হাত ফসকানো ক্রুশ কাঁটা, পশম টুকরো
চুরি করে তন্নিষ্ঠ ডালে বাসা বানায়।
ধারাল কুড়ুল একা একা সারা গ্রীষ্মে গাছ কাটে।
অসুখ
কাল রাতে স্ত্রী পাখিকে বশে পেয়েছিল নীড়ের ওমের লোভে
ডানা ক্লান্ত হয়, হৃৎপিণ্ড ক্লান্ত হয়, মাত্র একবার তারপর ভাসা
আরেক পাখির ডানা কাঁপানো জ্বর, আয়ত চোখে রামধনু
দীর্ঘ দীর্ঘ নয়, বিবশ কালো পালক।
বর্ষার সকালে সরপুঁটি এনেছিল ফসফরাস
শ্মশান কলসি থেকে জল।
কোটরে লুকিয়ে থাকা সাপ ছেড়ে দেয়।
উড্ডয়ন
গত গ্রীষ্মে যে স্ত্রী কাকটির কাছে আপন ডানার মহিমার কথা বলতে
—বিস্তার পাড়ি দেবার আদিখ্যেতা, পাতার অতিথি পোকা ধরা
নখের সাফল্য।
আজ নষ্ট ডিম, ঝড়ে ওড়া কুটো।
সম্পৃক্ত স্ত্রী-কাকের দিকে অদ্ভুত শীতলতায় সে
ভেসে যাচ্ছে গাছ থেকে ভূতনির চর।
নীচে আগ্নেয়াস্ত্র, গাঁ-জুড়ে ধর্ষণ, ঘুষ, রাজমহল পাহাড়
সদ্য যৌবন আরেক কাক শুধু ওড়ে।
রহস্যময়তা
যুবা কাক তার ডানা ভেঙে দিয়েছিল, তার বৈরিতা, কুকাজ,
সাদ্দামের ইরানের দিকে গোলা হানছিল নষ্ট গোলন্দাজ রোজ রাতে,
ছিনাল স্ত্রী-কাক পরম ঔদাস্যে সব দেখে ডালে ঠোঁট ঘষে।
প্রবল বৃষ্টির শেষে ঠাণ্ডা পাওড়ে জোরাল বাতাস
আর বন্যার সমস্ত রাস্তা, ডাস্টবিন ডুবে যায়; বন্যার্ত মানুষজন
দূরের বাঁধের দিকে হাঁটে।
কিসের ঘূর্ণিতে পড়ে কাক শুধু ঘোরে।
পরিযায়ী
বন্দুক উড়ে যায়, বিমর্ষতা, নদীর পাড় ভেঙে রোদ সরে
জ্বর সরে, তন্বী পাখিটি তেজাল হয়, তার জন্যে শুঁটকি মাছ,
ব্যবহৃত কনডোম, চকচকে আধুলি
ঢলানি ঠিকই উড়ে যায় শর জঙ্গলের খোপে
তৃপ্ত নবীন কাক বাতাসা চিরে ডাকে।
ছলাৎ ছলাৎ বিলের জল আস্বাদ নেয়
বুড়ো কাক। নবীন কাক শৈথিল্য ফেলে, নিস্তব্ধদ দুপুরে
মাঝবয়সী এক পাখির
সঙ্গে আধুলি নিয়ে পাহাড়ের ওপরে চলে যায়।
সনাক্তকরণের আগে
মোহ জীবনকে সমৃদ্ধ করে না, তাই সংগম শেষে ডানা ভাসায় কাক।
কাক ও কোকিলের ডিম মিশে থাকে খড়কুটোয়
কোকিলের গলায় ডাকে কাকের ছানা।
বাসি রুটি, পোস্ত-পটলের অবশেষে লোভ নেই,
নীড়ের ওম হাওয়ায় ভাসিয়ে একদা কাক চলে যায়
নখে ধরা আধুলি, রোদে চমকায়, ডানায় লুকোয়।
ওঙ্কার ধ্বনি
নদীর মোহনায় পলাশ লাল সূর্য খসে পড়ে
আর মুগ্ধ কাক দেখে, ওম পায়, কাক জলের কিনারা ছুঁয়ে
উড়ে যায় দিকচক্রবালে
হানাহানি ভালো নয়, জীবনপ্রণালী শান্তি খোঁজে
দিকচক্রবাল থেকে দিকচক্রবালে উড়ে যায় একা কাক।
চরাচর জুড়ে তার একা ডাক থাকে।
মাতৃতান্ত্রিক
পুরুষ কাকের মা-র অবসেসন আছে, অধুনা তার পালক
শীতে চকচকে হয় না এ বছর শীত
বেশ।
বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির, কাকের
শরীর কাঁপে, ডানার ওম তলানিতে;
ভোঁতা নখ, ভোঁতা ঠোঁট আসঙ্গ লিপ্সার কথা বলে
সাদা খোলা ফেলে পাখি উড়ে যাবার কথা ভাবে
আর মা-র কথা।
বাদামপাতা
দুর্লভ কাঠ-ঠোকারা উড়ে গিয়ে সুপুরির গুঁড়িতে বসে
চকিতে ডাকে।
প্রথম নারীর মতো শীতল ভোঁদর জল থেকে রোদে ফেরে
আর লেজ মোছে।
বাংলো বাড়ি উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে— কয়েকটা গাছ
নিয়ে জলাভূমি
আর মাছরাঙা।
বিশীর্ণ শিরাবহুল সবুজ পাতারা সমগ্র ছাদ পাহারা
দেয়।
তাম্রাভ বাদামপাতা ছাওয়া অ্যাসফল্টের রাস্তা
উত্তর দক্ষিণ ছোঁয়।
ধুলো ওড়ে, কর্কশ লরি বাতাস ভাঙে
এ রাস্তা সরস্বতীর পাড়ের শ্মশান ছোঁয়— প্রসূতিসদন
ইদানীংকালের কাকবন্ধ্যা স্ত্রীরা আলতো পায়ে হাঁটে
রোদে খাঁ খাঁ করে দিন জ্বলে যায় ঘাস, বেজির নরম লোম,
রাস্তার বাদামপাতা।
বৃষ্টি পড়ে, পশ্চিমের দৃশ্য মুছে যায়
ঘাস বাঁচে, মাছ বাঁচে।
বড়ো বড়ো পাতা ঘন সবুজ— নীলাভ রাস্তা ছোটে।
রাবণ
আমার দশটাই মাথা, কোনোটাই মুখোশ নয়,
কেনার পয়সা কই?
একদিনের জন্য একটা মাত্র।
সে বার মাস্টার ভিন্ গাঁয়ে চলে গেলে, নিজে নিজে মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
এবার দশটা লোক দিদিমার রোগা শরীর কাঁধে নিয়ে যায়
ফিরাতে রূপকথা হারিয়ে যায়।
ছোটো বৌদি যে ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল আর ওরা মেরে আড়িকাঠে টাঙিয়ে দেয়
সে মুখও কোথায় লুকোয়।
এখন একটা মুখ নিয়ে কোনোক্রমে থাকি, অল্প খাই কথা বলি কম।
এ মুখ পাছে চুরি যায়, ভয় পাই কবন্ধ হয়ে যাব শেষে।
দম্পতির প্রথম পাপ
১.
উনুনের ধোঁয়া আর আগুন আয়ু কেড়ে নেয়, স্বপ্ন;
লুকোনো সাদা চুলের বৃদ্ধি কোনো প্রশ্রয় দেন না।
রাতের ঘুমে ভীষণ-দর্শন সাপেরা আসে, বিষ উগরোয়,
ছেলের মাথা দরজা ছোঁয় আর হতাশা বাড়ায়
বিবি ও ছেলের।
২.
রোদ জানলা উজিয়ে মেঝে ছোঁয়, হিমালয় ঘুরে হাওয়া আসে
টেবিলে বেড়াল নিয়ে খাও— বেড়াল নিষিদ্ধ প্রাণী।
উলের ব্লাউজ, সাদা বোতাম কোনো শহর উজ্জ্বল করে উটাহোন জুড়ে;
শীতের পাতা, মন্ত্রোচ্চারণ।
৩.
টিলার পেছনে সূর্য ডোবে, হাতির দল শহর ঘেঁষে চলে যায়
আর সবুজ স্কুটার, সাদা হেলমেট পরা পুরুষ বুড়ি ছুঁয়ে স্টার্ট দেয়।
তখন টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, প্রিয় সিরিয়াল, ভয়।
আঁতুড়ঘরের কথা মনে পড়ে, সন্তানের মুখ।
নিজের জন্মযন্ত্রণা।
৪.
কমলা নাইটি, গর্ভনিরোধক, শেষ মিনিবাস হর্ন দেয়।
বন জুড়ে শিয়ালের চোখ, এক অটোরিক্সা ছোটে— আলো জ্বলে।
ওবেলার সবজি, গরম রুটি, স্যালাড,
অ্যালার্মঘড়িতে দম— এসব নিয়ে রাত পেরোয়।
বেড়াল পাশের বাড়িতে ছোটে।
৫.
ভোরের জলে ভঙ্গুর হয় নখ, হাত প্রথম বয়স ছোঁয়।
কারিপাতা তোলে, মাখন, স্লাইস রুটি পোড়ে, চা-র জল ফোটে;
না ঘষলে দাঁত বেড়ে মেরে ফেলে নরম শরীর।
সুবর্ণরেখার পাড়ে ফ্ল্যাট, ফোন, মেঘের বহর।
হনুমানমন্দিরে ভোরের ঘণ্টা বাজে।
৬.
সন্তানের চেয়ে প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘা, কুয়াশা ঢাকা শরীর পপলার, ঠান্ডা।
সন্তান পাহাড়ি শহরের মতো কিছু দিতে পারে?
দরজার বাইরে তাকে দাঁড় করিয়ে দার্জিলিং মেল ধরে সোজা শিলিগুড়ি।
খুব যত্নে নেপালি ফোকস্ শেখা, প্রথমবার ছ্যাং।
৭.
বয়স ক্রমশ বাড়ে, জীর্ণ স্মৃতি। কুয়াশার মধ্যে ঘোড়ার
গলায় টুংটাং জোরে বাজে।
প্রথম পুত্রের জন্য দৃষ্টি ঝাপসা হয়— মাছের চোখের জল
নদী জুড়ে নামে, রডোডেনড্রন ফোটে।
ব্যক্তিগত
বোদলেয়ারের পাতা ওল্টাই আর তাকে দেখি
সাদা লম্বা চুল শীর্ণগায়ে নীল পুলওভার— যা একটু আগে
পরিয়ে দিয়েছি।
নীচে বয়ে চলেছে সিন্ধু— আমার বাসের ভেতর,
সে আমাকে ম্যাপ খুলে বোঝানোর চেষ্টা করে নদের গতি— গাঁ
নীচে তাকালেই কেঁপে উঠছে শরীর...
পায়ের পাতায় মৃত্যু-শিরশিরানি আর একক পাখি
পার হয়ে যায় গিরিখাদ— নিঝুম প্রান্তর ধোঁয়া
তাকে জিজ্ঞেস করি প্যারিস থেকে এতদূর এসেছ তোমার মন কেমন করে না?
কেন? হাসে সে তার রোগা শরীর দুলে দুলে ওঠে।
বলি
—জান আমার গাঁয়ের কোয়ার্টারে পাখির আবাস
একা থাকি।
অথচ নীচে সিন্ধুর তীব্র স্রোত— পাহাড়ের প্রতি খাঁজের
খবর নিতে নিতে ছুটছে, দেখছি
আর মন হু হু করে ওঠে।
মণীন্দ্রনাথ ঘোষের পঞ্চম প্রুফ
শুধুমাত্র শুদ্ধিকরণের আশায় এ ঘাট থেকে অন্য আঘাটায় ভাসি।
বিদ্যেধরীর নদীর নৌ-রেখা ছুঁয়ে দীঘার পাথারে
খাঁচা ছেড়ে উন্মুক্ত দাঁড়ে যেমন সোনাগাছির উন্মুক্ত স্তন
জীবন কি প্রুফ যে বারবার বদলে নেব?
দ্বিতীয় প্রুফের সময় নতুন শব্দ চলে আসে, অন্যশর্ত, বাক্যবন্ধ।
ছন্দের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আর কম্পোজিটারের ক্ষোভ
শুদ্ধ নারীর বদলে নোনতা গেরস্ত,
বুককেসের বদলে লেখার মোহময় টেবিল বিদেশি কলম
কেবল চোখের ছানি গাঢ়তর হয়।
...
দীপ সাউ
(২৪ জুন, ১৯৪৬ — ১২ অক্টোবর, ২০১২)
প্রকাশিত বই:
কবিতা:
ডাইনিচরিত ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯১), দ্রাবিড় টোটেম (১৯৯৪), শামুকখোল ও সোনার ডিম (১৯৯৫, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ১৯৯৮), কাক ও জাতিস্মর (২০০২), বাদামপাতা (২০০৬), ডোমকাক ও হেতাল (২০০৬)
গল্প:
বৃষ্টির মানুষ (১৯৯৩), সাপ (১৯৯৯)
উপন্যাস:
কাকপক্ষী জানে না (২০০০), নীলকণ্ঠ (২০০৪), হিমঘর (২০০৯)
প্রকাশিত পত্রিকা:
এখন নিদাঘ
পেশা: শিক্ষকতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আধিকারিক
সংকলক : অনিন্দ্য রায়
ভালো উদ্যোগ
ReplyDeleteঅসাধারণ সব লেখা
ReplyDeleteদারুণ সব কবিতা
ReplyDeleteঅনবদ্য সংকলন।
ReplyDeleteঅনেকদিন পর দীপ সাউ এর কবিতা পড়লাম।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো লেখা গুলো পড়ে
ReplyDeleteঅসাধারণ প্রতিটা লেখা
ReplyDeleteঅসাধারণ প্রতিটা লেখা
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteদীপ সাউ আমি পড়ি। অসামান্য লেখা সব।
ReplyDeleteঅনবদ্য সংগ্রহ। দারুণ লাগল
ReplyDeleteপ্রতিটি কবিতা ভালো লেগেছে
ReplyDelete