বাক্‌ ১৪৪ ।। সঞ্জীব নিয়োগী



বিলগ্ন প্রত্নদিন আর তথ্যপ্রাকৃত খেলা

সেক্স ছাড়াও যদিও আরও অনেক কিছু ছিল, সেগুলোও শেষ অব্দি দানা বাঁধল না। আর তারা বিচ্ছিন্ন হতে অন্য কোথাও গেল না ঠিকই কিন্তু বিচ্ছিন্নতা তাদের দিনলিপি হয়ে থাকল।...
উৎননে যে শিলা উঠে এল, তার গায়ে খুব যত্নে এই কথাগুলো খোদাই করা আছে। উৎপল নিজে খোঁড়াখুঁড়ি-তত্ত্বাবধান করতে যায়নি। কেননা লুপ্তযুগ নিয়ে মানব সমাজে যে ধারণা তৈরি হয়ে আছে, মানব সমাজ বললে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, আসলে বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন এরাই আর-কি; তাদের মনে একটা ছবি আছে জেগে। সেটা এবার ভেঙে যাবে, এই উৎনন অনেক টাঙানো ছবি হাস্যকর করে দেবে। এটা শুধু উৎপল জানে। আর এযাবৎ, সবকিছু জেনেও সে চুপ ছিল; প্রবল যে ধারণা, তা তো অন্য খাতে বইয়ে দিতে পারত সে-ই। করেনি।
করলে কী হত? ভাবে আজ, উৎনন ব্যতিরেক কোথায় সমর্থন পেত সে! এমনকি, এই খোঁড়াখুঁড়ি করার অনুমতিই দিতে চাইত না কেউ, তা সে অনুমতি দেবার অধিকার কারও থাক বা না থাক।
আজ দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সমান করতে হবে জমিটা, প্রোমোটার মোটা লোভ দিয়েছে, তাই। নইলে প্রাচীন স্থাপত্যের দোহাই দিয়ে এমনই দাঁড়িয়ে থাকত আজীবৎকাল। সত্য প্রায়শই যেরূপে থাকে।
কিন্তু শিলালিপিটির এই যে ভাষা, এ কার ভাষা? এমনই কি ব্যবহৃত হয়েছিল সেইসব বর্ণনার দিনে, যা আসলে তথ্য, প্রাকৃত, নিরবচ্ছিন্ন গীতের আসরে? নাকি লিপিকার নিজেই ছিলেন জন্মকবি? মনের ভাষা চোখের দিকে চেয়ে পড়ে নিয়েছিলেন, সেই ভাষার আসল সম্ভাব্যতা? সম্ভাব্যরূপের লিপি শিলায় খোদিত হলে তা কি তথ্য হিসেবে মান্য?
প্রোমোটারের ফেলে দেওয়া প্রস্তাবে যদি জনগোষ্ঠীর, হকদারদের, লোভ না জন্ম নিত, তাহলে তো প্রাচীন স্থাপনা টিকেই থাকত আর উৎখনন আসতেই পারত না।
আজ তবে উৎপলের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিন।

.........

উৎপল থেমে যায়নি, কোনও এক সুপরিবেশিত মাঝপথে। মেনে নেয়নি সম্পর্কের ধামাচাপা ইতিহাস; বরং তা আরও ধূলিমলিন হতে দিয়েছে এরকমই এক উৎননের ভেতর থেকে সত্যের উঠে আসার আশায়। আসলে তাহলে প্রমাণিত হয়। নইলে কোন্দল বাধে গোষ্টিতে।
...কেননা তাঅনুসন্ধান জারি ছিল। মৃত্যু অব্দি থাকত কি? জানি না। কিন্তু পায়েল সম্ভবত আর কোনও রিলেশনে জড়িয়ে পড়েনি। অন্তত উৎপলের তেমন সোচ্চার কিছু নজরে আসেনি। এদিক দিয়ে সে হয়তো অকাট্য রেখে গেছে দ্বিতীয় অভিমতের প্রশস্ত পথ। আর উৎপল নিজে ক্রমাগত নানান দৃশ্যে অজস্রবার ঢুকে গেছে। খুঁজে গেছে, কিছু একটা, হয়তো প্রথম দিকে কী খুঁজছে, আর এটা যে আদৌ একটা খোঁজ, বুঝেনি। যা বুঝেছিল, তা আসলে নিজেকে এক যৌন-গোঁয়ার হিসেবে।... ক্লান্তিসমূহ খুব ধীরে এভাবেই গ্রাস করতে থাকে তাকে আর চলকে ওঠা অপরাধবোধ। এত শরীর এত শরীর এত্ত! যোনিভূক কীটের মতো মনে হয় নিজেকে আর সেই মতো অভিপ্রায়ে শুয়ে থাকে এক-একদিন। ভাবে।
...যদিও, যেন, সে হয়তো, মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ক্রমে... একটা নদী বা গাছ... পাথর কিংবা পাখি অনেক বেশি টানে এখন। টিভি, ফ্রিজ, খাট, দালান দূরে সরে গেছে ক্রমশ। বা, মানুষ, অন্য যে-কোনও পদার্থের মতোই। মানুষ ও পদার্থ অভিন্ন গুণসম্পন্ন, সম-বিকার আর ক্রমের কারণ! এত কথা ক্রমশ ভাবতে পারছে উৎপলতাহলে কী হবে আজ আর উৎখননের আলো নিয়ে উল্লাস করে। কী করবে সে এতদিন পর ওইসব ছাইপাশ ঘেঁটে। কী কেন কোথায় প্রমাণ নিয়ে হাজির হবে।
এখন অনেক দূরে চলে এসেছে সে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। একসময় হয়তো, হয়তো নয়, বাস্তবেই, বাইরে থেকেও বোঝা যাবে।

...............

একটা পাগলের সাথে যখন তোমার ভালোবাসার গান হয়, তখন তুমি সবচেয়ে সুখী মানুষ বাপধন।
উৎপল তখন তিন পেগ খেয়ে ওদিকে এসেছিল। কথাটা শুনল এবং শুনতে থাকল। শুনতে শুনতে শুনতে তার মনে নানান ভাব জন্ম নিল। ভাব যদি শুদ্ধ হয় তাহলে প্রশ্নের সমাপন ঘটে। কিন্তু উৎপলের মনে প্রশ্ন ওঠেবলে, সেই পাগল কি আগে থেকেই পাগল থাকবে নাকি আমার সঙ্গে গাইতে গাইতে ক্রমে পাগল হবে?... দেখল কোনও উত্তর এল না। অপেক্ষা করল। উত্তর এল না। তারপরও অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিড়বিড় করল, শালা! ভোঁসরি বালা! কে কথা বলছিল বে লুকিয়ে লুকিয়ে, সামনে আয় মায়ের দুধ খেয়ে থাকিস তো!... বয়স যখন পঞ্চাশদফা কৃচ্ছ আর অনাহারের শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত পেরিয়ে ধুঁকছে, আর শারীরিক কোষসমূহের অপার যন্ত্রণা বোঝার শক্তিও অবান্তর হয়ে এল, একদিন দেখা হয়ে গেল তোমার সঙ্গে, সুম্মেলি। আমি তারপর থেকে ক্রমশ বুঝতে থাকলাম, আমার যাবতীয়, নিত্যনতুন শরীর তলাশ আসলে ছিল অন্ধের মতো হাতড়ে যাওয়া, অনুসন্ধান।
ঠিক তোমাকে খুঁজেছি, হয়তো তা না-ও হতে পারে। কিন্তু তুমি এলে যবে, যখন, তারপর আরও বহুদিন ধরে ক্রমাগত এসেই চললে আমার দিকে উন্মোচিত হতে হতে, জীবনে সেই প্রথমবারের জন্য বুঝতে পারলাম অনিবার্য ও অপরিহার্য শব্দগুলোর মানে। নির্বিকল্প শব্দটা আরও কিছুদিন পরে যুক্ত হচ্ছে। যখন আলো ফুটে উঠল নিরেট অন্ধকারে। কে, কার হাত ধরে এসেছিল উৎপল এমনটা বারবার ভাবে, সুম্মেলি আর আলোর বিষয়ে।
প্রোমোটারের আগমনের খুশি সবার মনেই ছিল। কিন্তু উৎপলের আলাদা রকম আরও, যা অন্য কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। যে শুধু অকাট্য ভাবে উৎপলের এখতিয়ারে থাকে, সেই আনন্দ। ভালোমানুষ বলে বাইরের লোকের কাছে সমীহ পেয়ে মাথা উঁচু করে দরজা খুলে ঘরের ও বাহিরের নানা কাজ করে আবার ঘরেই মূলত ফিরে এসে শব্দ না করে দরজা লাগিয়ে বাকিটা নিঃশব্দ হয়ে যায় যারা, তারা প্রাকৃতিক ভাবে ঘটনা ঘটার অপেক্ষায় থাকে ও নিজেকে সেই ঘটনার জন্য নিরপেক্ষ দূরত্বে জাহির করে। আবার ঘটনার ভেতরে নিজের উপস্থিতি নিজেই দূর থেকে দেখে ও ম্লান হেসে অন্যদের দৃষ্টিও ওদিকে টানে।
প্রোমোটর নকশা দেখায়। ছোড়দি বলে তিনটে ফ্রি ফ্ল্যাটের কোনটা তার চাকেন বলে উৎপল জানে। কেউ যাতে তার চাহিদার বিরোধ করে। বিরোধ পেলে ছোড়দির সময় কাটে। ঘটনাবহুল সময়ে জেরবার থাকতে তার আনন্দ। সে তাই সবচেয়ে উপযুক্ত অবস্থানের সম্ভাব্য ফ্ল্যাট দাবি করে বসে থাকে। উৎপল বা বড়দির তাতে কোনও বিক্রিয়া ঘটে না। বড়দি ওসব অ্যাঙ্গেল বোঝেই না। উৎপল বোঝে। কিন্তু তাতে তার আগ্রহ নেই। সে শুধু উৎখননের দিকে আশা নিয়ে ঘোরে। আর গান গায়।...
একটা পাগল তার ভেতর থেকে উঁকি মারে। ঘরের আর বাইরের লোকেরা বিশেষণ লাগিয়ে বলে আড়ালে, সেয়ানা পাগল। শুধু সুম্মেলি বিশ্বাস করে, মানুষটা তার সঙ্গে গাইতে গাইতে পাগল হয়ে গেছে। সারাটা জীবন গান গাইতে পারেনি মনের আনন্দে তাই পাগল হয়ে গেছে। ভুলভাল মানুষের সঙ্গে গলা সাধতে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হাঁটাচলায় ঢুকে গিয়ে পথের বিভ্রান্তি মাখা, হতবাক, খাপছাড়া ছবির প্রকট নিয়ে বাঁচে।

.........

বাকি মানুষদের মধ্যে ধর্তব্যে রাখার মতো লোকজন আজ উৎখননের কথা আলোচনা করে।
বড় জামাইবাবু সদানন্দ যেমন তার বউকে বলেন, ভাইটা তোমার এক্কেবারে গেছে। বখাটে বহিনচোদ চিরকালই আলু চুলকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সাধে কি আর অমন ফুটফুটে বউটা, পায়েল, তার ওই দশা হল... দেখো, বুড়ো বয়সে ভেক ধরেছে আবার কয়টা দেহসঙ্গী না বালের সাধন সঙ্গী জুটিয়ে ইয়ে করে বেড়াচ্ছে!
এইরকম সব কথার পুরোটা শুনতে পায় না উৎপল। চাপান শোনে, উতোর পায় না। সওয়াল দেখতে পায়, জবাব শোনে না।
ব্যক্তিগত আস্বাদ সার্বজনীন হতে পারে না। যেরূপ, নিভৃত ঘন কুয়াশা ভেদ করে দুই হাতের সযত্ন বৃদ্ধাঙ্গুলি চাপে যোনিদ্বার ফাঁক করে, ধীরে, অনুভবের সময় যথেষ্ট মর্যাদা সহকারে উদ্বৃত্ত রেখে, যখন লৌহদণ্ডপ্রায় পুরুষ-প্রত্যঙ্গ প্রবিষ্ট হয়ে থাকে। ওইরূপ ব্যক্তিগত থাকে।
আরও ব্যক্তিগত হয়, তখন, যখন গলা ছেড়ে গান গাইবার স্বাধীনতা তৈরি হয় মহাকাশ জুড়ে।
সুম্মেলি এগিয়ে এসে মুখের ওপর অতি আর্দ্র যোনিভাগ আলতো ঠেকিয়ে বলে, হে চিরপিপাসিত ভ্রামক! নাও, লেহনের সুখসামগ্রী বিনিময় করো। আমার সমগ্র চেতনা তোমাতে নিমজ্জিত হইল। চেতনার আধার যে মানবদেহ, তোমাতে চরিতার্থ হইল। এই বিশ্বরূপ এই অস্তিত্বের সদর্থকতা এই জীবদেহের ইহকাল পরকাল সমস্ত স্মৃতি ও বিস্মৃতির ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হইতে আগ্রহী। আইসো, যৌথচার প্রারম্ভ হউক; যাহা অতিবিরল ঘটনা ও তাহার সাক্ষী প্রকৃতির উপাদানসকল। আর কেহ, কোনও বিষাক্ত আত্মার গোচর নহে ইহা।

..........

যেমন মহেঞ্জোদারো, হপ্পা ও তৎসম্পর্কিত এক্সটেন্ডেড এক্সাভেশন থেকে আসে। আর রহস্য আজও লিপির গায়ে কত না অনুসন্ধান লিখে রাখে। সিস্টেমেটিক, অ্যাকাডেমিক স্ট্রাকচার তাতে যায়, আসে। পায়েলের খোঁজ আর পাওয়া যায় না। পায়েল একটা দুঃখী, নিঃসঙ্গ, অবহেলিত চরিত্র হয়ে জনমনে বেঁচে থাকে।
এই গবেষণায় সুম্মেলির কথা কোনওভাবেই আসেনি এখনকেননা তা রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ উল্লেখ করেননি। তাই উৎপলের দুই দিদি আর তাদের দুজনের দুজন স্বামী, লোকচক্ষুর সামনে সুম্মেলি নিয়ে গবেষণা করেনি এই পর্যন্ত। এছাড়া আছে অন্যান্য আত্মীয় আর বান্ধববর্গ। তারাও ঝুঁকি নেয়নি বিষয়টাকে প্রকাশ্যে ওদিক দিয়ে দেখার।
পায়েল কি বিড়ি খেত? ছি। রামো। বিড়ি খাবে কেন। কিন্তু উৎপল যখন, যদি বা, কদাচিৎ উপগত হত পায়েলের লৌকিক শরীরে, পায়েল তখন সিংহভাগ সময় উৎকণ্ঠিত থাকত বহির্জাগতিক সুষমার দিকে। চঞ্চলতায়। এই কার ফোন এল যেন, কে ডাকছে মনে হয়, আচ্ছা ফিক্সড ডিপোজিটটা কি এই মাসেই ম্যাচিয়োর করছে না! বা, এমন আরও কিছু অনড় বৈপরীত্য সেইখানে, সেইসময় ঢুকিয়ে রাখত, যাতে লিঙ্গ শৈথিল্য অনায়াস মাথা গলায় মাঝখানে। আর একজন ডুয়ার, যদি তার দৃঢ়তা হারায়, তাহলে কী দিয়ে টিকিয়ে রাখবে পারস্পরিক লুপ্তপ্রায় মিসিং লিংক!
এইরূপে ধুলোর আধিক্য আর জনবসতির বিরলতায় গড়ে ওঠে প্রাচীন এক সভ্যতার ইতিবৃত্ত। যা আরও গল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে নৃশংস কিছু ঘটনার সত্যতা জেগে থাকলে। বেলা বাড়ে। তামাদি বিষয়গুলো আসলে উপযুক্ত জলহাওয়ার জন্য বেঁচে থাকে গল্পের সময়কাল জুড়ে। সেগুলো নিজের তাগিদেই টিকে থাকে। বা প্রোমোটার নামে কোনও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আসবে বলে।

.........

বিশুদ্ধ সেক্সও হয় যদি, তাতেও কৈফিয়তের কিছু নেই। হতেই পারে একথা একদিন ছোড়দি তার বরকে বলেছে। উৎপল ভাবে, একটা ক্রনোলজিক্যাল ও বোধগম্য তদুপরি মনোলোভা ব্যাপার সাজানোর জন্য একথা ভাবাই যায় যে ছোড়দি আরও বলেছিল সেক্স ছাড়াও আরও অনেক কিছু ছিল, যেগুলো শেষ অব্দি দানা বাঁধলর তারা বিচ্ছিন্ন হতে চাইল না...
জামাইবাবু বলবে, বিষ মিশিয়ে, আচ্ছা?
ছোড়দি উত্তর দিবে, একশো বার!
তারপর যা হয়, পরের বিষয়ে কত আর মাথা ঘামাবে, দুজনই আপাতত চুপ করে যাবে। আর এসব ক্ষেত্রে সেরকমই হয়; একজন পাকা চুল সাবধানে চাইনিজ কাঁইচি দিয়ে কাটতে চলে যায় আর অন্যজন ওয়াশিং মেশিনে ডিটারজেন্ট ঢেলে কাপড় কাচে বা ওই জাতীয় কিছু।
তবু ওদের লোভ জেগে থাকে। আর এত কথার মূলে সেটাই কাজ করে। পায়েল আর উৎপলের ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কের পাশ দিয়ে প্রোমোটারের হাতছানি বড় হয়ে দেখা দেয় সেই সকল মহলে যারা একটা করে ফ্ল্যাট পাবে। যেন কত ইনভলভড তারা এই সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে ভাইয়ের জীবনে। একতলা পুরোনো বাড়ি আর কদিন পরে থাকবে না। প্রচুর টাকা আর তিনখানা ফ্ল্যাটের প্রস্তাব দিয়েছে প্রোমোটার। সাততলা ইমারত হবে। ভিতের জন্য খনন হবে বহু গভীর।
এবার একদিন বলল, তুমি বায়োলজিক্যালি আমার পার্টনার নও। কেবল জুডিশিয়ালি। লেঃ শালা। সেটা আবার আসর করে ঘোষণা করার কী আছে। তবে, কথাটায় নতুনত্ব আছে, মজা আছে। বায়োলজিক্যালি নই, আমরা কেউ, পরস্পরের থেকে বেশ, নানাবিধ কৌশলী ব্যাপার ঘটে গেছে; শরীরে শরীর যায় না। ঠিকই তো বলেছে। প্রথম প্রথম করতে গিয়ে রক্ত ইত্যাদি বেরিয়ে তো গেছেই আর তা মিশে গেছে রোগজীবাণু সহ, ইফ এনি, একে অন্যের অতিক্রান্ত সীমায়। বাউন্ডারি ফেন্সিং না মানা তৃণভোজী পশু যথা।

.........

ওই টিমে আরও অনেকে ছিল। রাখালদাসকে মুখস্থ করা সহজ। প্রোমোটার কি একা নাকি। কাউন্সিলর অব্দি লিংক তো বোঝাই যাচ্ছে, আরও উপরে গেছে নিশ্চয়, সুতো।... সে যাক, ওদের টিম কি ক্রমে ক্রমে খুঁজে পাবে পায়েল আর উৎপলের বানানো মহাস্নানাগারের নকশা? আরও পরে, ব্রোঞ্জের পাত্রে লেখা সেইসব কঠিন দিনের গুপ্তভাষ! শালা, বোকাচোদা! ওহ, কেন যে গাল দিলগাল দিলে অবশ্য মনে একটা এরকম আসে। আসলে গাল যে দেয়, সে নিজেকেও একটু জুটিতে নেয় সেই ফাঁকে।
...বড়দি বলত, উৎপলকে শুনিয়ে শুনিয়ে, চরিত্রহীন ব্যাটাছেলেরা নিজের বউয়ের দিকে তাকাতে সময় পায় না, বুঝলি পায়েল। কত তো দেখলাম জীবনে। শুধু হাড়মাস গলিয়ে সংসারে ঢেলে যাও। এক-একজন এক্কেবারে পরিবারের বাইরের লোক হয়ে জন্মায়। বাপ-ঠাকুরদার জিন যেন পায়ইনি।
পায়েল তেমন উত্তর করত না। কেননা সে বুঝে ফেলেছিল বাপের বাড়ির সম্পত্তির মনের মতো ভাগে ভাই কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এই দুরূহ অনুমান তার ননদকে উৎপলের দিকে মিহি অবিশ্বাস আর বিষাদের আলোছায়া নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে।
সে তো জানে না, তবু পায়েল যেটুকু জানে, জানা সম্ভবও নয়, পায়েল যেভাবে জানে, উৎপল নামের এক যোনিভূক ক্রিয়েচার জমি-বাড়ি-টাকা-সম্পত্তি-সুখাদ্য-আত্মীয়স্বজন তুচ্ছজ্ঞানে, সবার উপরে শুধু নারীশরীরের স্বপ্নে, লিপ্সায়, চিন্তনে মগ্ন এক সময়-প্রবাহ-উপভোগকারী ছায়া। সে ছায়ার মতো আলগা হয়ে টিকে থাকে সৃষ্টির চোরাবালি উপেক্ষা করে। সেটা শুধু পায়েল জানে, পায়েলের মতো করে পায়েল জানে।
কত দশক আগে একটা ব্রোঞ্জের ছোট্ট নর্তকী মূর্তির পিঠের দিকে খোদাই করে লিখিয়ে নিয়েছিল পায়েল+উৎপলপাঞ্জাবের লুধিয়ানায় এক দোকানে, কর্মচারী অবাক করে বলেছিল, আমি স্যার মুর্শিদাবাদের লোক। বাংলায় লিখে দিব।
কুত্তার বাচ্চা! এই বলে যেদিন সেই ব্রোঞ্জমূর্তি আপ্রাণ নৃশংসতা আর ঘৃণার তীব্রতায় উৎপলের মাথা লক্ষ করে ছুঁড়েছিল পায়েল, তার আলতো নাতিবিরল রোমশ সেক্সি হাতে, বাঁচার চেষ্টা করলেও পারত না, তবু চেষ্টা করেছিল উৎপল, যদি না নিশানাভ্রষ্ট হতকোথাও একটা ঝনঝন কান ফাটানো আওয়াজ হয়েছিল। ওটুকুই, আর কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি মূর্তিটা। দেয়ালের পর দেয়ালের পর দেয়ালের পর দেয়াল ভেদ করে কি সেটা, পায়েল+উৎপল, অফেরতযোগ্য আড়ালে চলে গেছে! লোক-চোখের বাইরে!
উৎপলের কিছুই যায় আসে না, প্রোমোটর কী কেন কবে কোথায় কীভাবে! আসুক, ধীরে, যেভাবে সত্য আসে। মানুক সবাই, সেই উঠে আসাকে। বুঝুক সবাই যে, সে নির্মোহ এবং প্রচুর ভুল তাকে নিয়ে বানানো হয়েছে। আসলে অত যোনি সে মোটেও দেখেনি যতগুলো নিয়ে বিভিন্ন মহলে গল্প চালু আছে। আর, যোনি কেন, ভাগ! অন্ধ যেমন আপাদমস্তক হাতড়ে, হাতড়েও, অনুমান না করতে পারলে আর তার অভীপ্সা না মিটলে শুঁকে কামড়ে চুষে তোলপাড় করে দিতে চায় দিগ্‌বিদিক, সেরকম! যোনি নয় রে, খ্যাপাচোদা, যোনি নয়। আর তাই যদি হয়, লিখে নে, একটা শব্দবাঁধন, ভুক্তযোনি! হল? যা, সরে যা!
বেশ তবে কথা না বাড়িয়ে বলো দেখি, তোমার যদি ধ্বজভঙ্গ থাকত? বা পরে কখন হত?
কল্পনা নিয়ে কথা বলিস না ভাই। যা বাস্তবে নেই এমন পরিস্থিতি আমি ভেবে নিয়ে কোথায় যাব, বল! কত পিএইচডি, সেমিনার, আন্তর্জাতিক নয়ছয় শুধু লিপি উদ্ধারে গেল, বল? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সাহনি’ ছিল পদবি, কী নাম মনে নেই, ওই উৎখনন দলে ছিলেন, রাখালদাসের সঙ্গেতিনি পরে রাজমহল হিলসে এসেছিলেন সিন্ধুলিপির সঙ্গে সাঁওতালদের বিভিন্ন চিহ্ন আর ঘরের দেয়ালে আঁকা চিত্রের মিল খুঁজে পেতে।... বলো, কত নিবিড় খোঁজ, এক-এক মানুষ তো একা-একাই করে গেছে। আজও...। তবে না অনুসন্ধান একটা মানের দিকে যাবার ঝোঁক হারায় না। যাত্রাপথটাই রোমাঞ্চের। ভরা থাকে।

........

সুম্মেলি ভগ্নস্তূপ পার করে হেঁটে আসে।
তবে সে প্রত্নবিষয়ক আগ্রহে এটা করে তা নয়। অপূর্ব ক্ষুধা ও তৃষ্ণা বুকে নিয়ে মাঝবয়স পার করে সে উপেক্ষা-জর্জরিত পদব্রজে আগে থেকেই যাত্রা করেছিল। সে, জানতই না, জনবর্জিত এক সভ্যতার কঙ্কালে উৎপল উদ্ভ্রান্তের মতো দিন কাটায়। নির্বাচনের বিভ্রান্তি যখন দিনের আলোয় রাখ-ঢাক হারিয়ে পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনের লজ্জা উপেক্ষা করার মতো অতৃপ্তি নিয়ে আসে, একজন সর্বহারা তখন অনির্দিষ্টকালের পথে একা ও উদ্দেশ্যহীন, বেপরোয়া। নিরুপায়। হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা বারবার, অতি দীর্ঘ উপত্যকা বরাবর উপেক্ষা করতে করতে করতে বৈরাগ্য এসে যায়। আর সেই বৈরাগ্যপথে দেখা হয়ে যায় আরও এক নিঃস্ব সর্বহারা তোয়াক্কাহীন পথচারীর সাথে। পথচারী, এক্ষেত্রে, তাহার পূর্বঅনুরাগী। আর, একথাও, আসলে সুম্মেলি বা উৎপল কেউই জানত না যে, মরুমধ্যে কাঁটাগাছ এইরূপ বৃক্ষসম। বস্তুত, বৃক্ষ বানিয়ে নিতে পারল যৌথ হাহাকারের জলসিঞ্চনে।... এটা তবু এক ও এক দুই হল না। বরং আরও একটা এক হয়ে গেল; বা, একক। সুম্মেলি বা উৎপল দেখল, একাকার।
ছোড়দি আঁচ পেয়ে বিড়বিড় করল, হতচ্ছাড়ি মাগি!
পায়েল বলল, তাহলে ঘরেই এনে তোলো, দুপাশে দুজনকে নিয়ে শুয়ে থাকবে, আমি তোমার চুষব আর তুমি ওই মাগির গুদে মুখ ঢুকিয়ে চাটবে! শালা! মাদারচোদ ব্যাটাছেলে! মারতে হয় লাথি পাছায় কষিয়ে এক্কেবারে বাপের নাম ভুলে যাবে! কুকুর কোথাকার!
সুম্মেলি কিন্তু, আসছিল যখন হেঁটে, ভগ্নস্তূপ পার করে, তুমুল কলহে উৎপলের মাথা তাক করে মারা ব্রোঞ্জমূর্তির হারিয়ে যাওয়া এবং বিপজ্জনক ভাবে বেরিয়ে থাকা কানায় বা কোনও উঁকি মারা অংশে পা কেটে যায়নি তার অথবা হোঁচটও খায়নি প্রত্ন অবশেষের ঘেরাটোপহীন অবশেষে।
বরং প্রতিধ্বনিত কিছু অভিসম্পাত আর অট্টহাসি শুনেছিল বলে আজ মনে পড়ে। প্রত্ন-ভগ্নাংশে যেভাবে ধ্বনি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে।
পার্টি করতে করতে মদের দোকানের লাইসেন্স, মেয়ের মাস্টারির চাকরি, ছয় খান মাছ চাষের র্বর পুকুরের লিজ, জেলখানার মিল সাপ্লাইয়ের ঠিকা ইত্যাদি হাতিয়ে নিতে নিতে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও ছোট জামাইবাবু ছোড়দির বুকে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, কী ছিরির চরিত্র মাইরি, তোমাদের বাপের বাড়ির বংশে! আর কেউ এমন ছিল, নাকি ওই ছোঁড়াই এমন বংশ-ছাড়া হয়েছে!
ছোড়দি ব্রা ঢিলে করে বরের কথায় সায় দেয়, দেখো কী কাণ্ড! এই বয়সে, না? বজ্জাতটা বলে আবার পায়েল নাকি মন দিয়ে শুতে চায় না, শোয় না! ছি ছি, মাগো!
কে বলল এসব কথা, উৎপল নিজেই?
আরে যাহ, ও কেন, বেচারি পায়েলই বলেছে একদিন মনের দুঃখে...
বুক ডলতে ডলতে জামাইবাবু জানতে চায়, তা কী বলল পায়েল?
কী আবার। বলল, মন দিয়ে আবার কীভাবে শুতে হয় বলো দিকি ছোড়দি। মেয়েছেলে চি হয়ে পা ফাঁক করে শুবে, ব্যাটাছেলে উপরে উঠে করবে, কাজ হবে চলে যাবে, এর আবার অত ব্যাখ্যার কী আছে বলো দিকি! বললাম, মরণ! উৎপল কি পাগল হয়েছে নাকি! যত্তসব!
তা বলে কী, না গো ছোড়দি, অনেক রকম কথা কয় তোমার ভাই আজকাল, বলে শুলেই নাকি সব দিতে পারা যায় না, শরীর তো নয়ই! কী জানি কী! পাগলই হয়েছে বুঝি। মায়া হয় গো, বুঝলা, মেয়েটাকে দেখে...
রেডিয়োকার্বন ডেটিং থেকে কয়েকটা তথ্য উঠে আসে ও তিথি নির্ধারিত হয়। সেখান থেকে মানুষেরা, যাদের উৎপল আর পায়েল বিষয়ে জ্ঞান থাকে, তাদের অনেকেই একটা উৎসাহ আর পরিণতি পায়। সুম্মেলি বিষয়ক অভিলেখ প্রকাশ পেলে, তখন আরও অনেক কাহিনির জন্ম হয়। যার সঙ্গে তখনও এবং পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতান্তর ঘটে। ঠিক সেরকমই, যেমন ইতিহাস সাক্ষ্যপ্রমাণের নিরিখে অনেক রূপে বেঁচে থাকে। তখন ওরাও, উৎপল, পায়েল আর সুম্মেলি অনেক চোখ দিয়ে নিজেদের দেখতে পায়। দেখাগুলো বাতাসে ভেসে থাকে।
সন্নিহিত শরীরের উন্নাসিক মরু পেরোতে পেরোতে একদিন হাঁটতে থাকে উৎপল। লিপি উদ্ধারের বাসনাও ততদিনে শেষ হয়ে এসেছে। ধুলোর পরে ধুলো জমতে জমতে সম্ভাব্য সভ্যতার বুকে অবহেলার ঢিবির পাশে বসে থাকে আর পরিত্রাণের কথাও উঁকি দেয় না মনে। বা, দেয়। বুঝতে পারে না।
পায়েলও কোথাও দূরে চলে গেছে। দূর থেকে তার ছুঁড়ে মারা ব্রোঞ্জমূর্তির ঝনঝনানি প্রতিধ্বনিত হয়। সেই শব্দ অশ্রুতপূর্ব ও অশ্রুতিগোচর। তবু শুনতে পায়, পিছু ছাড়ে না। সুম্মেলিও শুনতে পেয়েছে কয়েকদিন। বলে, আছে, গোপন থেকে আমাদের অনুসরণ করছে, জানো। আমার কেমন গা ছমছম করে। মাঝখানে একটা ছায়া ঢুকে থাকে, আমাদের শান্তির মাঝখানে। কোথায় থাকে বলো তো, দেখতে তো পাই না। ও কি সত্যি মারা গেছে?
সন্দেহ উৎপলেরও হয়।...

7 comments:

  1. পড়লাম। আপনার এই দ্বন্দ্বময় ডায়ালেক্টিক রোজকার জীবনকে এক প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষিত দেয়। আপনার বেশিরভাগ গল্প শেষে আমি ধন্দে পড়ি। এখনকেই তো পড়লাম, তাহলে এত বহমান সুপ্রাচীন বোধ জন্মাছে কেন পাঠ শেষে। আমি গদ্যকে রাজনৈতিক বোধ ছাড়া পড়তেই পারি না। সেই বোধ আমাকে বিপন্ন না করলে কীসের গল্প!! আপনার লেখা আরেকবার বিপন্ন করল।

    ReplyDelete
  2. আমি গল্প খুব কম প'ড়ি। এ গল্প তবু পুরোটা ধৈর্যশীল হ'য়ে প'ড়লাম। অসাধারণ লেগেছে। পরবর্তীতে আরো পড়ার আগ্রহ র'ইলো।।

    ReplyDelete
  3. বাঃ। কী অদ্ভুত সমাপতন! জীবনের প্রাগৈতিহাসিক খননের গল্প। বাঃ।

    ReplyDelete
  4. সঞ্জীব তোমার গল্পের সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠছি। রহস্যময় ও গভীর বৌদ্ধিক সামিয়ানার অন্দরে কি গভীর এক হিংস্রতা। আর কি সংঘর্ষময়...প্রাগৈতিহাসিক চেতনা।

    ReplyDelete
  5. সঞ্জীব তোমার গল্পের সঙ্গে ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠছি। রহস্যময় ও গভীর বৌদ্ধিক সামিয়ানার অন্দরে কি গভীর এক হিংস্রতা। আর কি সংঘর্ষময়...প্রাগৈতিহাসিক চেতনা।

    ReplyDelete
  6. এর ভাষা, গল্প, গদ্য তিন ডাইমেনশনে অতুলনীয় লেখনী । সুন্দর ।

    ReplyDelete
  7. অসম্ভব সম্ভাবনাময় একজন লেখকের গল্প পড়লাম ।প্রত্নতাত্ত্বিক আবহে কী এক রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চারে ধীরে ধীরে নিয়ে গেছেন পাঠককে । সিন্ধুলিপি পাঠোদ্ধার হয়নি , কিন্তু "বিলগ্ন প্রত্নদিন আর তথ্যপ্রাকৃত খেলা " র নায়কের টানাপোড়েনের লিপি , পারিবারিক সম্পর্ক গুলো কিংবা সামাজিক অসংগতি গুলো প্রতীকির মধ্য দিয়ে পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে । ভাষা তার নিজের গতিতেই চলেছে ।যা স্বাভাবিক । এভাবেই এগিয়ে চলুন । শুভেচ্ছা রইল ।

    ReplyDelete