বাক্‌ ১৪৪ ।। আবেশ কুমার দাস



ভয়

ফাঁসটা বেঁধে ফেলেছিল আগেই। গলিয়েও নিয়েছিল গলায়। সিলিং ফ্যানের রডে শাড়িটা জড়াতে টুলে উঠেছিল রতন। ভাবছিল, আর ক’ মিনিট...
          তখনই চোখে পড়েছিল প্রাণীটাকে। ক্যানোপির গায়ে লেপটে দু’ চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। বিস্ময়! তাই হবে। মনুষ্যেতরের উপলব্ধিতে একটা ধাঁধার মতোই হওয়ার কথা আত্মহত্যার শিকার নয়, খোদ নিজেকেই শেষ করে দেওয়ার জন্যও যে এই নীলগ্রহে চলতে পারে লড়াই, মানুষ বাদে বাকিরা কী বুঝবে তার!
          অতশত মাথায় আসেনি অবশ্য তখন রতনের
          হুড়মুড় করে নেমে এসেছিল টুল থেকে।
          দু’ বছর কেটে গিয়েছেআরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যই সেদিনের পর থেকে লড়ে যাচ্ছে রতন।
          আত্মহত্যা করতে কলজে লাগে। এমনটাই মনে হয় তার।
          খুব কষ্ট হলে ইদানীং তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে।
          সাহস করে যেদিন উঠে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে ওদের মুখোমুখি, সেদিনই ঝুলে পড়ার কথা ভেবে রেখেছে রতন।




কুকুরের আর্যত্ব

আর্যতত্ত্ব একটা ওয়েস্টার্ন কনস্পিরেসি, পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে বলছিলেন পরিমলবাবু, নাথিং মোর দ্যান দ্যাট। কোনও পাথুরে প্রমাণই নেই বাইরে থেকে কারও আসার...
          কিন্তু সায়েন্স তো বলছে আদিম মানুষের জন্ম আফ্রিকায়, যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছিল সত্যেন, তাহলে আফ্রিকার বাইরে ভূমিপুত্র বলে কি কিছু থাকা সম্ভব...
          সেই এক্সোডাস আরও আগেই হয়েছিল সত্যেন, পরিমলবাবুর কণ্ঠে দৃঢ়তা, কিন্তু ইতিহাসের যে পর্বে এদেশে আর্যদের আগমন বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে এতকাল...
          একটু থেমে ড্রয়িংরুমের বিশাল বুকশেলফটার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব পরিমল লাহিড়ি, আসলে এদেশেও যে বিকাশ ঘটতে পারে উন্নত সভ্যতার, সেটাই মানতে পারছিল না ব্রিটিশরা। সেই অহমিকা থেকেই এমন থিয়োরির নির্মাণ। আর দুঃখের কথা, এদেশেরই কিছু ইতিহাসবিদ বরাবর তোল্লাই দিয়ে গিয়েছেন...
          সদরের দিক থেকে ঠিক তখনই ভেসে এল চেঁচামেচিটাউত্তেজিত গলায় কিছু বলছেন পরিমলবাবুর স্ত্রী অহল্যাদেবী।
          কথা থামিয়ে উৎকর্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকেন পরিমলবাবু। পাইপে টান দিতেও যেন ভুলে গিয়েছেন
          একটু পরেই সদরের দিক থেকে ঠিকে কাজের বউয়ের পিছু পিছু ফিরতে দেখা গেল অহল্যাদেবীকে।
          পরিমলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আবার নোংরা করে গেছে তো?
          আর কী বলছি! অষ্টপ্রহর এত চোখে চোখে রাখা যায়...
          বাবুয়ার মা বেরিয়েছিল বাইরে?
          বেরিয়েছিল আদিখ্যেতা করতে। শুনিয়ে দিয়েছি দু’ কথা...
          বেশ করেছ। কিছু বলল?
          ওতেই তো মাথাটা জ্বলে গেল আরও। বলে কিনা ওরা তো অবলা জীব দিদি। অত বুদ্ধি আছে...
          বুদ্ধি নেই তো নিজের ঘরেই পুরে রাখুক না...
          তাই বলেছিশুনিয়ে দিয়েছি, কুকুর পুষলে ট্রেনিং দাও তাদের তুমি রাস্তার কুকুর বাড়িতে ভরে আদিখ্যেতা করবে আর পেচ্ছাপ-পায়খানার সময় তাদের ছেড়ে দেবে বাইরে...
          আর ট্রেনিং! যেমন মানুষ তেমনি কুকুররুচির বালাই আছে এসব লোকের! আমি থাকলে বলতাম, পুষতে হলে পোষো না একটা ভাল জাতের ল্যাব্রাডর, কি জার্মান শেফার্ডনেড়িকুত্তা নিয়ে যত ন্যাকামো...




চতুর্থ বিশ্ব

চার কিলো চাল, সাতশো ভাঙা মসূর, পাঁচশো তেল...
          ফর্দ ধরে ধরে বুঝে নিয়ে নির্বিকারে পাঁচশোর নোটটা বাড়িয়ে দেবে গণপতি গণৎকার। ক্যাশবাক্সে চালান করে তিনটে ফিরতি কুড়ি তুলে নেবে মানিক মুদিও। খুচরো তিন টাকার জন্য যদিও পেতলের বাটিটা হাতড়াতে হবে খানিক
          মাসখানেক থাকবে নোটটা এখন মানিকের কাছেইহাত ঘুরে হয়তো যাবে এরপর মেছোহাটার মালতুর বুকপকেটে।
          নিঝুমপুরের মধ্যেই ঘোরে নোটটা।
          খুব বেশি হাতবদল হয় না।
          পাছে দ্রুত জ্যালজ্যালে হয়ে যায় বেশি ব্যবহারে।
          অনেকদিন চালাতে হবে নোটটাকে এই না-শহর না-গ্রাম নিঝুমপুরের অর্থনীতিতে।
          তারপর পাঁচশোর বাজারদর যেদিন গিয়ে ঠেকবে পাঁচ টাকায়, অনেক হাত ঘুরে আবার গদাই গোয়ালার হাতেই ফিরবে সেদিন নোটটা। একটা অঘটন যদি ঘটেও যায় ততদিনে, গদাইয়ের ওয়ারিশকে ফেরত নিতে হবে নোটটা। পাঁচ টাকার লোকসান মানিয়ে নেওয়াই যায়।
          সন ২০১৬-র ৩০ ডিসেম্বরের অনেকদিন পর নিজের ঘরে বাতিল পাঁচশোটাকে খুঁজে পেয়েছিল গদাই।

8 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. প্রথমটা জাস্ট অসাধারণ।

    ReplyDelete
  3. আর্যত্ব এবং পেডিগ্রীর ব্যাপারটা ভাবার মতই।

    আর ভেবে দেখলে, চতুর্থ বিশ্বের মানুষ অনেক বেশি সংবেদনশীল। ভরশাযোগ্য।
    আর্বান নেটিজেন মোবাইল ফোনে কোড স্ক্যান করতে করতেই বলে দেয় -- কারো কোথাও কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।

    ReplyDelete
  4. আর, চরিত্রের নামকরণের ব্যাপারে আপনি এখনও বেশ সাবেকীই আছেন। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রতিটি গল্পই চিন্তাউদ্রেককারী। আত্মহত্যার মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে এমন একটা ব্যবস্থা নিয়েও আসতে পারে অনাগত সময়। সারমেয়কুলে অনার্যগুলো প্রশিক্ষণ পায় বিদেশী রীতিতে। প্রকৃত জাত্যভিমান এমনি কি আর বিপন্ন? অবাক করলেন চতুর্থ বিশ্বের নাগরিকরা। এবং তাঁদের স্রষ্টাও। অর্থনীতির গভীর পর্যবেক্ষণ ও বোধের কারণে।

      Delete
  5. আর্যতত্ত্ব ও নিজেদের হিপক্রিসি বেশ লাগল। চতুর্থ বিশ্ব এখানেই। আমরা কেবল দেখতে পাচ্ছিনা এখনও। ভয় কৌতূহল তৈরি করেছে। মনস্তত্ত্ব বড় জটিল ব্যাপার।

    ReplyDelete