বাক্‌ ১৪৪ ।। বাইসন শিকারের গল্প মিসেস ডব্লু ডব্লু বেইলি (এস. এল. বেইলি) ।। ভাষান্তর: গৌরব বিশ্বাস




তখন আমরা ঘাঁটি গেড়েছি, ধারওয়ার। সেখানে থাকতেই একদিন খবর এল কানারার জঙ্গলে নাকি বেশ কিছু বাইসনের দেখা মিলছে। শিকারের জন্য একদম উপযুক্ত। কানারার জঙ্গলে যেতে হলে ধারওয়ার থেকে যাওয়াই সুবিধের। অতএব, তাঁবু গুটিয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য পড়লাম বেরিয়ে।
আমার সঙ্গে রেল কোম্পানির একজন ফায়ারম্যান। লোকে তাঁকে মজা করে ডাকে জংলি বেড়াল। খেতাবটি  অতিরঞ্জিত নয়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সে যখন চলে টুঁ শব্দটি হয় না। ঠিক বেড়ালের মতোই। পায়ের চাপে একটা শুকনো ডাল-পাতাও ভাঙে না। এমন নিঃশব্দে চলে লোকটা, জঙ্গলের মধ্যে কখন কোথায় যে সে থাকে বুঝে ওঠা দায়। মাঝেমধ্যে পিছনে ফিরে দেখি, ঠিকঠাক এল কিনা। তবে জঙ্গলকে সে চেনে একেবারে হাতের তালুর মতন।
শিকারের জন্য আমি সাধারণত এক্সপ্রেস রাইফেল আর স্টিল টিপড বুলেট ব্যবহার করি। তবে এবারে বেরোনোর আগে এক বন্ধু বলল বাইসন বড় সাংঘাতিক জানোয়ার। তোমার ওই এক্সপ্রেস রাইফেল দিয়ে ঘায়েল করা মুশকিল। বন্ধু তার বারো বোরের রাইফেলটা আমায় দিল, বলল বুঝলে, এ বন্দুকটায় কিছু সমস্যা আছে। ডান দিকের ব্যারেলের হ্যামারটা ঠিক মতন কাজ করে না। শট নেওয়ার পর বাঁ-দিকের ব্যারেলটা মাঝেমধ্যে জ্যাম হয়ে যায়। তবে তোমার কাজ চলে যাবে। কী আর করি! এমন বন্দুক নিয়ে শিকারে বেরোনো বিপজ্জনক। পাছে আমার বন্ধুটি মনঃক্ষুণ্ন হয়, তাই তাঁকে না করতেও পারলাম না। শেষমে বন্দুকটা সঙ্গে নিয়েই নিলাম।
আমরা তাঁবু ফেলেছি, ছোটো একটা গ্রামে। নাম তার আটলি। গোটা দুই কুঁড়েঘর বাদে আর কোনো বসতির চিহ্ন চোখে পড়ল না। আমাদের তাঁবুটা একেবারে জঙ্গলের মাঝে। চারদিকে নিবিড় অরণ্য। একটুও খোলা জায়গা নেই। চারিপাশটা ছবির মতো সুন্দর। তবে বিপদও রয়েছে। আমার চিন্তা বিশেষ করে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে। রাতের বেলা ওরা তাঁবুর বাইরে বাঁধা থাকে। সেসময় নিশাচর বুনো জানোয়ারের পেটে যাওয়া আশ্চর্যের নয়!
'জংলি বেড়াল' বলল বাইসন মারতে হলে রাত থাকতে থাকতে বেরোনোই ভালো। রাত দুটোর আগে বেরোতে পারলে ভালো হয়। কতদূর জঙ্গল ভাঙতে হবে জানি না। অতএব শেষরাতের অন্ধকারেই পড়লাম বেরিয়ে। ঘন্টাদুয়েক চলেছি জঙ্গল ভেঙে। চারপাশে কাঁধ সমান উঁচু লম্বা ঘাস। ঠান্ডা শিশির ভেজা। ডিসেম্বরের কনকনে শীত। আরও কিছুক্ষণ চলার পর 'জংলি বেড়াল' থামল। আমি জিজ্ঞেস করলাম— ‘এরপর? জংলি বেড়াল বলল আপাতত এখানেই অপেক্ষা করুন।’ ভোর হতে তখনও কিছু সময় বাকি। হিমে ভিজে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দিনের আলোর প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। একসময় ভোরের আলো ফুটল। জংলি বেড়ালবেশ কিছু শিকারের স্পটের কথা বলেছিল, সেগুলোর সন্ধানে বেরোলাম। কিন্তু রাস্তা খুঁজে পেলাম না।
প্তাহে প্রায় প্রত্যেকদিনই বেরোতাম। তবে প্রথম দিনের মন বিশ্রী অভিজ্ঞতার পর, আর আমি শেষরাতে বেরোতে নারাজ। পাঁচটার আগে বেরোতামই না। একদিন একটা ছোট বাইসন মেরেছিলাম। কিন্তু সেসব ফলাও করে লেখবার মতন কিছু নয়।
'জংলি বেড়াল' বেশ হতাশ। আক্ষেপ করে বলল মাস তিনেক সময় হাতে করে এলে ভালো হত। ততদিনে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে জঙ্গলে কচি ঘাস গজাত। তখন  ঠিক মিলত বাইসন।
মাস তিনেক বাদে মার্চ মাস নাগাদ আবার গেলাম জঙ্গলে। এবার অবশ্য জংলি বেড়াল আমার সঙ্গে নেই। কাজ থেকে ছুটি পায়নি। এবার সঙ্গে রয়েছে সুবরাও। সুবরাও দক্ষ শিকারি। আমরাই ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছি। দুর্দান্ত হাতের টিপ। আরও একটা গুণ আছে তাঁর। সুবরাওকে কোনোদিন মিথ্যা কথা বলতে শুনিনি। সুবরাও ছাড়াও আরও দুজন স্থানীয় রয়েছে আমার সঙ্গে— মহাদেও আর গণপত।
এক সকালে ক্যাম্পের বাইরে বসে একটু লেখালেখি করছি, হঠাৎ মনে হল আমার টুপির উপর কিছু একটা টুপ করে খসে পড়ল। হালকা নরম কিছু। ততটা গা করলাম না। ভাবলাম, গাছের থেকে পাতা-টাতা কিছু পড়েছে বোধহয়। একটু বাদে আবার হল ওরকম। তারপর চলতেই থাকল। নীচে তাকিয়ে দেখি, নীচটা মিষ্টি গন্ধের ছোট ছোট সাদা ফুলের থোকায় ভরে গেছে। উপরের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। কতগুলো বানর গাছ থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে, আর ফুল ছিড়ে আমায় তাক করে ছুড়ে মারছে। যেই বুঝতে পারল আমি ওদের লক্ষ করেছি, মনি সব গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আবার যেই আমি লিখতে বসলাম, মনি পুষ্পবৃষ্টি শুরু।
ণ্টাখানেক ধরে চলল ওদের বাঁদরামি। আমার চারিপাশে সাদা ফুলের ছোটোখাটো একটা গালিচা হয়ে গেল। আমার দিকে একটা করে ফুল ছোঁড়ে আর আনন্দে কিচমিচ করে ওঠে। আমি আঙুলের ফাঁক থেকে টুকি দিয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছি। আমাকে ফুল ছুঁড়ে ওদের কী যে আনন্দ! অবশ্য আমিও খুব মজা পেয়েছি ব্যাপারটায়।
ভোর হওয়ার আগেই প্রতিদিন বেরিয়ে পড়তাম আমরা। তখনও চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বনের ভিতর পথ চেনা দায়। আমার লোকেরা চলেছে টর্চ-লন্ঠন হাতে। বনের ভিতর একটুকরো ফাঁকা জমি খুঁজতে ভোরের আলো ফুটে যেত। তারপর শুধুই বাইসনের প্রতীক্ষা। কখন, তারা ঘাস খেতে আসবে। কোনোদিন পুবের আকাশ ফরসা হলে, জঙ্গলের ভিতর এঁদো  ডোবাগুলোর ধারে বাইসনের পায়ের ছাপ খুঁজতে যেতাম।
একদিন মহাদেও এসে বলল সে নাকি জঙ্গলে বিশাল এক বাইসন(১) দেখতে পেয়েছে। এই এত্ত বড় শিং হাত দিয়ে মেপে দেখায় মহাদেও। চললাম তাঁর সঙ্গে সেই বাইসনের খোঁজে। মহাদেও যতটা বড় বলেছিল, ততটা বড় নয় মোটেও। এসব ছোটোখাটো বাইসন মেরে কোনো মজা নেই।
সুবরাও একটা বুদ্ধি বের করল। কোনো একটা উঁচু জায়গায় উঠতে পারলে জঙ্গলটাকে ভালো করে দেখা যায়। তাতে বেশ সুবিধাই হবে আমাদের। গণপত আর মহাদেও জঙ্গল টহল দেবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। গণপত আর মহাদেও জঙ্গল টহল দিতে বেরোলো। আমি আর সুবরাও চড়ে বসলাম একটা উঁচু জায়গায়। আর সেখানে উঠেই আমার চক্ষুস্থির। মাত্র ষাট গজ দূরে বাইসনের বিশাল একটা দল ঝোপের আড়ালে ঘোরাফেরা করছে। মহাদেও আর গণপত টহল দিতে দিতে সেদিকেই এগোচ্ছে। দুজনেই বেঁটেখাটো মানুষ, ঝোপের আড়ালে বাইসনের দলটিকে লক্ষ করেনি কেউই। কিন্তু আমি উপরে বসে সব দেখতে পাচ্ছি। আর-একটু কাছে এগোলেই, ওদের শব্দে বাইসনগুলো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে। কোনোরকমে দৌড়ে গিয়ে দুজনকে থামালাম।
জায়গাটা একেবারে ন্যাড়া। এদিক-সেদিক কয়েকটা ঝোপঝাড় ছাড়া বড় কোনো গাছ নেই। আমরা অতি সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে কয়েক গজ এগোলাম। তারপর সবচেয়ে বড় সিংয়ের বাইসনটার পিছনের কাঁধে নিশানা লাগলাম। ঠিক তখনই একরাশ  কুয়াশা এসে সামনের দৃশ্যপট ঝাপসা করে দিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। কুয়াশা সরে যেতেই দেখলাম বাইসনটা হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে। আর দেরি না করে চালালাম গুলি। দুটো ব্যারেলই দিলাম ছেড়ে। অব্যর্থ লক্ষ্য। গুলির আঘাতে বাইসনের পিছনের দিকটা পঙ্গু হয়ে গেল। সেই মুহূর্তেই আবার কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল চারিপাশ। আর ঠিক তখনই জঙ্গল কাঁপিয়ে প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি। ছত্রভঙ্গ বাইসনের দলটা দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। আমার সামনে পিছনে চারিপাশ থেকে দুদ্দাড় করে জঙ্গল ভেঙে ছুটে চলেছে বাইসন। সে এক ভয়ানক কাণ্ড
এই হুড়োহুড়ির মধ্যে বাকি দুজনের পাত্তা পেলাম না। কোথায় গেল কে জানে। সুবরাও আমার পাশেই ছিল। ওর হাত থেকে পয়েন্ট ফাইভের ফ্রাসার(২) রাইফলেটা নিলাম। হাফ ডজন বাইসন ছুটতে ছুটতে গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েছে। বাকিগুলো মাত্র পনেরো গজ দূরে। দৌড়ে পালাচ্ছে। ওদের মধ্যেই নধর দেখে একখানা নিশানা করে চালালাম গুলি। কাজের কাজ কিছু হল না। সবকটা একছুটে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।
যা গেছে যাক। একটু আগে যেটাকে গুলি করেছি এবার সেটার উপর নজর পড়ল। ওটা তখন ক্রোধে উন্মত্ত। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একরাশ জিঘাংসায় তাকিয়ে আমাদের দিকে। পিছনের পা দুটো ব্যবহারের ক্ষমতা নেই। হাঁটুতে ভর করে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়েছে। মাথাটা সামান্য ঝুকিয়ে উন্মাদের মতো শিং দিয়ে ক্রমাগত গুঁতো মেরে যাচ্ছে মাটিতে। মাটি পাথরের ঘূর্ণি ধুলোয় ছেয়ে গেছে চারিপাশ। আমাদের আক্রমণ বা নিজের আত্মরক্ষা যাই বলি না কেন, কোনো ক্ষমতাই আর তার নেই। অসহায় নিষ্ফল ক্রোধে মাটিতে দাপাদাপি করছে প্রকাণ্ড দানবটা।  ওর পিছনের পা দুটোয় যদি ক্ষমতা থাকত, কী যে হত ভাবতেই শিউরে উঠি। একমুহূর্ত দেরি না করে রিলোড করলাম রাইফেল। আবার চালালাম গুলি। ব্যস, সব শান্ত। নিশ্চুপ। আমি আর সুবরাও দেখতে গেলাম। বাইসনটা তখন প্রায় নিস্পন্দ। মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। তবুও মাঝেমধ্যে মাথা তুলে মাটিতে গুঁতো মারার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাঁচবার শেষ প্ৰচেষ্টা। সত্যি, বাইসনের শরীরের ভাইটাল স্পট যে কোনটা, কোথায় গুলি করলে যে মরবে বোঝা খুব মুশকিল।
এতক্ষণে মহাদেও আর গণপত এসে হাজির। বাইসনটা সামনের পা দুটো টানটান করে উঁচিয়ে। একটা বাঁশের টুকরো দিয়ে বাইসনটার ঘাড় থেকে সামনের পায়ের খুর অবধি মাপলাম। লম্বায় দাঁড়াল আঠারো হাত দুই ইঞ্চি। বাইরের দিকে মাথা সিং নিয়ে চওড়ায় বিরাশি ইঞ্চি।
এবার তাঁবুতে (গণপত মজা করে আমার তাঁবুটাকে বলে 'বাংলো') ফিরতে হবে। তাঁবুতে ফিরে মাইল আটেক দূরে কুলিদের খবর পাঠালাম। ওরা বাইসনের চামড়াটা ছাড়িয়ে মুণ্ডু সমেত নিয়ে আসবে।
আমার খানসামারা খুব করে ধরল আমায়। ত বড় শিকার তাঁরা একবার দেখতে চায়। দিলাম অনুমতি। ওরা দেখে অবাক। ওরা ওটাকে হাতি ঠাওরেছিল!
গোটা একটা দিন কেটে গেল। বাইসনের মাথাটা তখনও এল না। পরের দিন চারজন মিলে খুঁটিতে বেঁধে মৃত বাইসনটাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এল। দেখে মনে হয়, যেন বিশাল এক থোকা আঙুর(৩) খুঁটি থেকে ঝুলছে। ত বড় একটা জানোয়ারকে চারজন মিলে বয়ে আনতে হাঁফ ধরে গিয়েছিল ওদের। কিন্তু মুশকিলে পড়লাম বাইসনের চামড়া নিয়ে। বাইসনের চামড়া ওরা ছাড়ায়নি। আমারাও কেউ বাইসনের চামড়া ছাড়াতে জানি না। কিন্তু  ওটা থেকে ইতিমধ্যে বেশ বিশ্রী গন্ধ ছেড়েছে। আমার পর্তুগিজ বাবুর্চি জেরনিমো বলল, সে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারে। অতএব দুজনে মিলে লেগে পড়লাম কাজে। মাথার পিছনে ঘাড়ের কাছে চামড়াটা বেশ মোটা। জেরনিমো দেখলাম বিফস্টেকের মতো পুরু করে কাটছে। আমাদের তো শুধু  চামড়া দরকার। জেরনিমোর কাণ্ড দেখে অবাকই হলাম। কিন্তু শেষে দেখলাম জেরনিমো দিব্যি উরে দিয়েছে কাজটা। বাইসনের চামড়া ওভাবেই ছাড়াতে হয়। এর থেকে পাতলা করে চামড়া ছাড়ানো অসম্ভব।
এরপর আরও একদিন বেরিয়েছিলাম বাইসন শিকারে। ভোর হতে তখনও বাকি। দেখি, জঙ্গলের ভিতর একদল বাইসন দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আমাদের উপস্থিতি টের পেতেই সবকটা উঠে অন্ধকারে ছুটে পালাল। আবছায়ায় ঠিক মতন ঠাহর করতে না পেরে নির্বোধের মতো একটা কাজ করে বসলাম। বড় একটাকে বাগে পেয়েছি মনে করে বোকার মতো গুলি ছুঁড়লাম। পরে দেখলাম, আমার গুলিতে একটা মাদি বাইসন মারা পড়েছে। ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক।
এটুঁলির জন্য কানারার এ জঙ্গলের খুব বদনাম। বড় বিরক্তিকর পোকা। গোলমরচিরের গুঁড়োর মতো ক্ষুদে। শুকনো ঘাসের মধ্য দিয়ে চললে আপাদমস্তক এটুঁলিতে ভরে যায়। দেখলে মনে হবে, সারা গায়ে কেউ গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে। ক্ষুদে পোকাগুলো বেশ করে সেঁধিয়ে যায় চামড়ার তলায়। গা থেকে এদের ঝেড়ে ফেলা দুঃসাধ্য। স্ক্রাব কোম্পানির অ্যামোনিয়া(৪), সাবান, ভেসলিন যা-ই ব্যবহার করুন, এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। একদিন দেখি, আমার কবজি থেকে কনুই অবধি প্রায় তিনশো এটুঁলি ছেঁকে ধরেছে। অসহ্য চুলকানি। বিশেষ করে রাতের বেলা। সারারাত এপাশ-ওপাশ গড়িয়ে সারাক্ষণ চুলকে যাও। অনেকসময় এটুঁলির কামড় বিষিয়ে ওঠে। আমার এক বন্ধুকেই একবার এটুঁলির কামড়ে অসুস্থ হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বাইসন বলুন বা চিতাবাঘ, কানারার জঙ্গলে এটুঁলির হাত থেকে কারও নিস্তার নেই।
প্রথম যেবার আটলি গেলাম, এটুঁলির আক্রমণে একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেছিলাম। কিন্তু পরের বার গেলাম আটঘাট বেঁধে। একটা বুদ্ধি বার করলাম। অবশ্য এটাকে আমার নিজস্ব আবিষ্কারও বলতে পারেন। মাঝেমাঝে ভাবি এমন জম্পেশ আবিষ্কারের পেটেন্ট নিলে মন্দ হত না। একটা পোশাক বানালাম। তবে সাধারণ পোশাক বলতে যা বোঝায় তেমনটা নয়। এটাকে বরং ব্যাগ বলতে পারেন। লম্বাটে ডিম্বাকার একটা ব্যাগ। নীচের দুপাশে পা গলানোর মতো ব্যবস্থা রয়েছে। পা গলিয়ে চলাফেরা করা যায় দিব্যি। দুপাশে হাতাও রয়েছে। পুরো জিনিসটা পাতলা সিল্কের তৈরি। আপাদমস্তক পুরো শরীরটা ঢেকে ফেলা যায়। এর উপর দিব্যি চাপানো যায় জামাকাপড়, এমনকি মোজাও গলানো যায়। ঘাড়, কবজির চারপাশ অনেকটা ঢেকে দেয় ব্যাগটা। অবশ্য এমন ব্যবস্থা এটুঁলিদের না-পসন্দ। তার উপর ঘাড়ে আর কবজিতে কেরোসিন আর তামাক পাতার রস বেশ করে ঘষে নিলাম। বড় বিশ্রী গন্ধ। কিন্তু এটুঁলিদের জব্দ করতে সব সইতে রাজি। আমার বুদ্ধিতে এটুঁলিরা জব্দ হল। শিকার থেকে ফিরে জামাকাপড় খুললেই দেখতাম, শয়ে শয়ে এটুঁলি ব্যাগের গায়ে ঝুলে আছে। কিন্তু আমার কিস্যুটি করতে পারেনি। আমার বানানো 'এটুঁলি নিরোধক' ব্যাগের এমন সাফল্যে মনটা খুশি হয়ে ওঠে। তারপর জামাকাপড় আর ব্যাগ সব ছেড়ে বাইরে ফেলতাম। আমার চাকর কুন্ডি(৫) সেগুলোকে ফুটন্ত গরম জলে চুবিয়ে দিত।
সেবার যখন বাইসনের খোঁজে বনে গেলাম, তখন বর্ষার শেষ। জঙ্গল তখন জোঁকেদের স্বর্গ। ঘাসের ডগায় চুপটি করে মাথা উঁচিয়ে বসে থাকে, যেই কেউ ও পথ ধরে যাবে মনি তার গায়ে ঝুলে পড়বে। আমাদের দলের এক শিকারি লক্ষীমন বলেএদেশের লোকেরা নাকি জোঁককে খুব ডরায়। একা-একা জঙ্গলে চলতে বিশেষ সাহস হয় না। এমনকি জঙ্গলের পথে যেতে যেতে দুণ্ড বিশ্রাম নেওয়াও বিপজ্জনক। পাছে ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসে। আর তাহলেই সর্বনাশ। জোঁকেরা তখন সব রক্ত শুষে মেরেও ফেলতে পারে।
এক সন্ধ্যায় লক্ষ্মীমনের সঙ্গে একটু জঙ্গলে বেরিয়েছিলাম। ফিরে আসার পর কুন্ডি আমার গামবুট খুলতে গিয়ে আঁতকে উঠল। চমকে দেখি, মোজাজোড়া রক্তে ভিজে উঠেছে। কয়েকটা জোঁক মেঝেতে খসে পড়েছে। বাকিগুলো তখনও আমার পায়ের পাতা থেকে ঝুলছে। বিরক্ত হয়ে বলি— ‘এহে, এগুলোকে ছাড়াব কীভাবে? আমাদের দলের হুসেইন একেবারে খাঁটি জংলি লোক। জঙ্গলের সব আটঘাট ওর জানা। ও হেসে বলল এ আর এমন কী? এই দেখেন... হুসেইন একদলা তামাক মুখে পুরে বেশ করে চিবোতে লাগল। তারপর নিজের পায়ের দিকে দেখিয়ে বলল— ‘এই ধরেন এইখানে জোঁক লেগেছে, এবার দ্যাখেন কী করি। এই বলে সে মুখ থেকে তামাকের রস পুচ করে ছিটিয়ে দিল নিজের পায়ে। এসবে আমি অভ্যস্ত নই। তাই কুন্ডিই আমার পায়ে তামাকের রস, নুন ইত্যাদি লাগিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে জোঁকগুলো টুপটুপ করে খসে পড়ে। এটুঁলি যা জ্বালিয়েছে আমায়, জোঁক ওদের কাছে কিছুই না।
একদিন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তখন শেষ বিকেল । হঠাৎ মনে হল জঙ্গলের ভিতর কিছু নড়াচড়ার শব্দ পেলাম। হুসেইন বলল এ বাইসন (হুসেইন অবশ্য বাইসন বলে না, ও বলে 'কুলগা') না হয়ে যায় না। ওই বাঁশঝাড়টার পেছনে রয়েছে মনে হয়। যদিও হুসেইন জানোয়ারটার শিং দেখতে পায়নি, তবে দলছুট যেহেতু বেশ বড়সড়ই হবে। একাই এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আমায় টের পেয়ে জানোয়ারটা বিরক্তিতে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে সরে গেল। মনে হল, শিংটা যেন একঝলক দেখতে পেলাম। জানোয়ারটা সম্ভবত আমার দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে ছিল। পা টিপে টিপে সন্তর্পণে এগোতে থাকলাম। জানোয়ারটাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। জঙ্গলের মধ্যে জায়গা খুঁজে ঠিকঠাক পজিশন নিলাম। এখান থেকে আন্দাজ করে জানোয়ারটার বুকে করলাম গুলি। সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ উন্মাদের মতো গর্জন ভেসে এল। আমার লোকজন দাঁড়িয়েছিল একটু তফাতে। ওদের কাছে আর-একটা রাইফেল আনতে গেলাম। ওরা বলল— ‘মেমসাব, এ তো বাইসনের গর্জন মনে হচ্ছে না। এ নির্ঘাত বাঘ আছে। অনেক্ষ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। চারিদিক নিস্তব্ধ। মাঝেমধ্যে জানোয়ারটা গর্জন করছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। লক্ষীমন এদিক-সেদিক দেখে এসে বলল বেশ কিছুটা দূরে একটা কুলগাকে নাকি মাথা নাড়তে দেখেছে। আমার গুলিতে সম্ভবত ভালোই জখম হয়েছে জানোয়ারটা। ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা শব্দ। যেন কোনো জানোয়ার জঙ্গল ভেঙে দুদ্দাড় করে এগিয়ে আসছে। হুসেইন চেঁচিয়ে বলল পালাও সব, জংলি কুলগা এদিকেই এগিয়ে আসছে...’ সবাই এদিক-সেদিক দৌড়ে গাছে উঠে পড়ল। কয়েকজন মিলে ঠেলেঠুলে আমাকেও একটা গাছের ডালে তুলে দিল।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। গাছ থেকে নেমে গুলি ছুঁড়ে আবার ছুটলাম গাছের দিকে। কিন্তু বাইসনটা আর এল না। বড় অদ্ভুত ব্যাপার। আবার গাছ থেকে নামতে গেলাম। এবার একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেল। যে গাছটাতে উঠেছিলাম, ওটার গুঁড়ির চারিধারে কাঁটাঝোপের বন। গাছ থেকে নামতে গিয়ে পা গেল হড়কে। গাছের গুঁড়িটা জাপটে ধরার চেষ্টা করতেই কাঁটার খোঁচায় হাতের তালু কেটেকুটে একাকার। সেভাবেই হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে নীচে নামলাম। এমনই দুরবস্থা, রাইফলেটাই ঠিক মতন ধরতে পারছি না। গুলি চালাব কী করে! ওই অবস্থাতেই কোনোমতে বার দুই গুলি চালালাম। জানোয়ারটা পা ছুঁড়ছিল। সেদিকে লক্ষ্য রেখে ওর দেহ আন্দাজ করে গুলি ছুঁড়লাম। লক্ষ্মীমন কাছে গিয়ে দেখে এল। বলল গুলিতে একটা বাইসন মারা পড়েছে। ছোটখাটো সাইজের বাইসন। শিং দুটোও বিশেষ বড় নয়। এর জন্য কিনা এত কাণ্ড!
এ জঙ্গলে যে কত বিচিত্র ধরনের মাকড়সা রয়েছে! সকাল সকাল জঙ্গলে গেলেই ওদের দেখা মেলে। কোনোটা কালো, কোনোটা হলদে, কোনোটার গায়ে আবার ডোরাকাটা। বড় সুন্দর দেখতে। ঝোপেঝাড়ে বড় বড় জাল বুনে রাখে। এক-একটা  জাল ছয়-সাত ফুট চওড়া। লম্বাও তেমনি। বেশ শক্ত আর আঠালো। অসতর্ক হয়ে চললে গায়ে জড়িয়ে যায়।
একদিন বাঘের খোঁজে জঙ্গল বিট করছি, অনেক্ষণ ধরে বিট করেও কোনো লাভ হল না। বাঘটার কোনো খোঁজ নেই। বিটিং তখন চলছে। এমন সময় স্টেশন মাস্টার এসে খবর দিল, বাঘমশাইকে নাকি লাইনের ধারে দেখতে পাওয়া গেছে। কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে দিব্যি তিনি মালগাড়ি দেখছেন!
এক সকালে বেরিয়েছি বাইসনের খোঁজে। একটু আগেই একপশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে রয়েছে। দিব্যি চলেছি নিঃশব্দে। ভেজা পাতায় একটুও শব্দ হয় না। ভেজা মাটিতে বেশ কিছু খুরের দাগ চোখে পড়ল। বেশ বড়সড় কয়েকটা বাইসন এ পথে গেছে মনে হচ্ছে। খুরের দাগ অনুসরণ করে কিছুটা এগোতেই বাইসনের দলটাকে দেখতে পেলাম । দলটা বেশি বড় নয়।  নধর দেখে একটা বাইসন খুঁজতে লাগলাম। গোটা দুয়েক মাঝারি সাইজের পুরুষ বাইসন রয়েছে। কয়েকটা স্ত্রী বাইসনও চোখে পড়ল। কিন্তু শিকার করার মতো একটাও পেলাম না। কী আর করা। রাইফেলগুলো আনলোড করে কুলির হাতে ধরিয়ে দিলাম। রাইফেল আনলোড করার শব্দে বাইসনগুলো চমকে তাকাল। সেই মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য চোখে পড়ল। দুটো বাঘ গাছের আড়াল থেকে বাইসনের দলটার দিকেই এগোচ্ছে। আমাদের মতো বাঘদুটোও গাছের আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল বাইসনগুলোর উপর। আমাদের উপস্থিতি বাঘদুটো টের পায়নি। আমার রাইফেল আনলোড করার শব্দে বাইসনগুলো চমকে তাকাতেই বাঘদুটো থমকে দাঁড়ায়। বাইসনগুলোও এবার বাঘদুটোকে দেখতে পেয়েছে। দলের সব বাইসন একসঙ্গে জড়ো হচ্ছে। গোল করে ঘিরে দাঁড়াল। আগত শত্রুর বিরুদ্ধে সব একজোট হয়ে লড়বে। খেলা গেছে ঘুরে। বাঘদুটো এবার একটু করে পিছু হটতে শুরু করল। প্ল্যান বানচাল হয়ে গেছে বুঝতে পেরে হেলতে দুলতে ফিরে যাচ্ছে বাঘদুটো। মাঝেমাঝে পিছনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। আমি দেখলাম, বাঘ শিকারের এই তো মওকা। আমার রাইফেলটা কুলির কাছে। কিন্তু কুলিকে তখন রোখে কে! বাঘ বাঘ চিৎকার জুড়ে ভয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুট লাগিয়েছে। খালি রাইফেলটাই তাক করেছে বাঘের দিকে। ভয়ে বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। আমার আর-একটা রাইফেল শিকারির কাছে। সেও তখন কুলিকে থামাতে তার পেছনে ছুট লাগিয়েছে। হাত-পা ছুঁড়ে শিস দিয়ে কুলিটাকে থামানোর চেষ্টা করছে। শেষ অবধি কুলিটাকে থামানো গেল। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাইফেল আর কোনো কাজেই লাগবে না। গোলমাল বুঝে বাঘদুটো জঙ্গলে চম্পট দিয়েছে। বাঘ মারার চক্করে বাইসনগুলোর কথা খেয়ালই নেই। ফিরে দেখি বাইসনের দলও বেমালুম হাওয়া।
একদিন জঙ্গল বিট করে ছোট একটা বাইসন ধরা পড়ল। একেবারেই শিশু। দিন কয়েক বয়স হবে হয়তো। বেচারা আমাদের দেখে ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। একটা শাবককে মারতে মন চাইল না। জঙ্গলের জন্তুকে অসহায় ভাবে হত্যা করায় কোনো বাহাদুরি নেই। ও বরং থাক। ওর মা এসে ঠিক ওকে খুঁজে নিয়ে যাবে। আমার লোকেদের ওকে ছেড়ে দিতে বললাম। না হলে হয়তো ওরা ওকে কেটে খেয়েই ফেলত। তবে আমি ফিরে যাওয়ার পর কী হবে জানি না। দলের লোকেরা বাচ্চাটাকে আদৌ ছাড়বে? কে জানে!


লেখক পরিচিতিঃ মিসেস এস. এল. বেইলি (S.L. Baillie)। জন্ম ১৮৫৬ সালে ইংলন্ডে। ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়া। বাবার কাছেই শিকারের প্রথম হাতেখড়ি। যৌবনে, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর পাদরি উইলিয়াম বেইলিকে বিয়ে করে ভারতে চলে আসেন। ছোটবেলার শিকারের শখ এখানে এসে আবার জেগে ওঠে মিসেস বেইলির। কখনও হাজব্যান্ড উইলিয়ামের সঙ্গে, বেশিরভাগ সময় একাই বেরিয়ে পড়তেন শিকারে। সঙ্গে দু’-একজন স্থানীয় শিকারি। মিসেস বেইলির শিকারের অভিজ্ঞতা বড় বিচিত্র। রোমাঞ্চকর। কখনও মোকাবিলা করেছেন বাঘের সঙ্গে, ক্রুদ্ধ বাইসনের সামনে পড়েও সাহস তার টলেনি। কখনও ভাল্লুকের হাতে হয়েছেন গুরুতর জখম, তাও দমেননি এতটুকু। জঙ্গলের উদ্ভট সব পোকামাকড়কে সামলেছেন দিব্যি। ‘ব্রিটিশ স্পোর্টস অ্যান্ড স্পোর্টসমেন: বিগ গেম হান্টিং অ্যান্ড অ্যাংলিং’ বইতে তাবড় তাবড় সব পুরুষ শিকারিদের মাঝে তাঁর নামটিও সমুজ্জ্বল। নিজের দেশে ফিরে এদেশের শিকারের অভিজ্ঞতা নিয়ে ধরলেন কলম। তখন তাঁর বয়স পঁয়ষট্টি। একমাত্র গ্রন্থ ‘ডেজ অ্যান্ড নাইটস অফ শিকার’ প্রকাশিত হল ১৯২১ সালে। বইতে অবশ্য মিসেস বেইলি ব্যবহার করেছেন তাঁর বিবাহ পরবর্তী নাম মিসেস ডব্লু ডব্লু বেইলি। এই বইয়েরই অন্যতম রচনা ‘বাইসন জাংগলস’, এই রচনারই বাংলা ভাবানুবাদ করেছি আমি। পুরুষ শিকারিদের কলমে শিকারকাহিনি বহুল প্রচলিত। কিন্তু এক নারীর কলমে শিকার, জঙ্গলের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে অনন্য।


..................................................................................................................
১. মূল গল্পে এই স্থানে ছিলকুলগৌড় (Khulgaur)। পৃথিবীর অনেক দেশেই বাইসনের দেখা মেলে। এর মধ্যে ভারতীয় প্রজাতিটির নাম গৌড় (gaur)। লেখিকা এই রচনায় কোনো স্থানে লিখেছেন বাইসন কোথাও লিখেছিলেন কুলগৌড়। যেহেতু নেটিভরা বাইসনকে এই নামেই ডাকে। অনেক স্থানে লেখিকা পুরুষ বাইসন বোঝাতে বুল (Bull) ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বাংলা অনুবাদের সময় ‘বুল’-এর আক্ষরিক অনুবাদ পুরুষ বাইসন করলে অনুবাদের সাবলীলতা হারায়। আবার ‘বুল’-এর অর্থ ষাঁড় করলেও বিভ্রান্তির সম্ভাবনা। তাই অনুবাদের সময় সব ক্ষেত্রেই বাইসন বলেই উল্লেখ করেছি। যেক্ষেত্রে পুরুষ এবং স্ত্রী আলাদা করে উল্লেখের প্রয়োজন শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই আলাদা করে উল্লেখ রয়েছে।
২. ফ্রাসার এক সময়কার বিখ্যাত স্কটিশ রাইফেল কোম্পানি। মূলত শিকারের রাইফেল বানাত। প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েল ফ্রাসার। এক রাইফেল কোম্পানির সাধারণ এক কারিগর থেকে নিজের রাইফেল কোম্পানি খুলে বসা, ড্যানিয়েলের এই যাত্রাটা অভূতপূর্ব। একসময় ড্যানিয়েল ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত রাইফেল নির্মাতা আলেকজান্ডার হেনরির কর্মচারী। ১৮৭৩ নাগাদ ড্যানিয়েল নিজের একটা কোম্পানি খুলে বসলেন এডিনবার্গে। অবশ্য সবই চলত আলেকজান্ডার হেনরির নামে। ১৮৭৮ নাগাদ ড্যানিয়েল, আলেকজান্ডারের কোম্পানি থেকে ইস্তফা দিলেন। এবার সম্পুর্ন ঝাড়া হাত-পা। সঙ্গে পেলেন ভাই জনকে। কোম্পানির নাম হল D. & J. Fraser।
১৮৮৯ নাগাদ দুই ভাইয়ের পার্টনারশিপ ভেঙে গেল। ড্যানিয়েলের নিজের কোম্পানির নাম হল Daniel Fraser & Company। ভাই জনের কোম্পানি বেশিদিন চলেনি। কিন্তু ড্যানিয়েলর কোম্পানি টিকে ছিল তাঁর মৃত্যুর রেও। ১৯৩০ নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় এই কোম্পানি। বিভিন্ন শিকারিদের বন্দুক, গুলি, বন্দুকের যন্ত্রাংশ কী বানাত না ফ্রাসার কোম্পানি! এদের অভিনব টেকসই সব বন্দুক ছিল এককালের দক্ষ সব শিকারিদের অন্যতম ভরসা। সে সময় এই কোম্পানি বন্দুকে টেলিস্কোপিক লেন্সও লাগায়।
৩. মূল গল্পে এই স্থানে ছিল 'pictures of Canaan grapes'। অনুবাদের সুবিধার্থে এক থোকা আঙুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 'Canaan grapes' বাইবেলের ঘটনা। দুনিয়ার অনেক বিখ্যাত শিল্পীই তাঁদের তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন এই ঘটনাকেদুজন ব্যক্তি বিশাল এক থোকা কালো আঙুর একটা খুঁটিতে বেঁধে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
৪. সেকালের ইংলন্ডের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানি Scrubb & Co. ওরা বানাত Scrubb's cloudy anmonia। স্নানের জলে দু ফোঁটা থেকে শুরু করে, বাথরুম পরিষ্কার, ঘরদোর মোছা, বাসন ধোয়া বা পোকার কামড়ে লাগানো স্ক্রাব কোম্পানির অ্যামোনিয়া চলত সবকিছুতেই। লন্ডনের মহিলাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা পায় স্ক্রাব কোম্পানির এই প্রোডাক্ট। মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনে মাথায় রেখেই বানানো হয়েছিল এটা। স্ক্রাব অ্যামনিয়ার বিজ্ঞাপনেও তারই ছায়া Britain's hard-working house wives.... IT'S REALLY KIND TO THE HANDS
৫. লেখা পড়ে মনে হয়, লেখিকার চাকরের নাম কুন্ডি। তবে ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে এখানে কুন্ডি সম্ভবত কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। কুন্ডি আফগানদের একটা ট্রাইব। সম্ভবত লেখিকার ওই চাকরটি জাতে ছিল আফগান কুন্ডি। তাই মন নাম।





ছবি সৌজন্যঃ‌ ফ্রাসার রাইফেলের বিজ্ঞাপন- Post Office Directory Advertiser, 1882, Page no: 79
                       Canaan Grapes- The Jewish Museum, Newyork এর ওয়েবসাইট
                       Scrubb's cloudy ammonia এর বিজ্ঞাপন- সেকালের বিলেতি সংবাদপত্র।

No comments:

Post a Comment