সুন্দর পৃথিবী
এমন নিশ্চয়ই নয় যে, আজ অবধি পৃথিবীতে কেউ কারও পা ইচ্ছাকৃতভাবে মাড়িয়ে দ্যায়নি। কেউ কেউ ইচ্ছা করেও অন্যের পা মাড়িয়ে দ্যায়। একটা খুন যে হতে পারত, কিন্তু হল না, এর পিছনে একটা কারণ আছে।
সেই কারণটা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর।
শ্যামল আজ চটি পরেনি। বুট পরে আছে। গতকালও বুট পরেছিল। আজ বুট পালিশ করেছে সকালে অনেক সময় দিয়ে। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল। বুটে কাদা লেগেছিল। এখন কাদা লেগে নেই।
ভাদ্রমাসের উজ্জ্বল আকাশের মতো নিষ্কলঙ্ক এখন শ্যামলের বুট। জেল থেকে বেরিয়ে আসা সাজা শেষ করা মানুষের মুখের মতো এখন শ্যামলের বুট।
সামনের সুন্দরী যুবতীটি সুন্দর স্লিপার পরেছে।
“ডানলপ... ডানলপ...”
“আউচ! দেখে যেতে পারেন না, না কি!!!”
“ভিড় দেখতে পাচ্ছেন না?”
“আবার কথা বলছেন! সন অফ আ বিচ...”
পৃথিবী সুন্দর।
কারণ এই পৃথিবীতে ভিড়বাসের মধ্যে কোনো হত্যাকাণ্ড হয় না। ঠান্ডা নির্জীব গহ্বরের মধ্যে কোনো প্রতিধ্বনি হয় না।
রূপকথা
“দিনের আলো ফোটার একটু আগে ঘুম ভাঙবে আমাদের। একটা বিরাট হলদেটে চাঁদ তখন ঝুলে আছে আকাশে। চাঁদটা অবিশ্যি একটু একটু করে ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। আমাদের ঘিরে ঘাসের জঙ্গল। একটা দুর্ঘটনার মতো আবহ আমাদের ঘিরে। ঘাসের শিসগুলো এতই লম্বা যে মনে হচ্ছে যেন আমরা শৈশবে ফিরে গেছি। আকাশের রংটা নীল হবে নাকি বেগুনি, যেন ঠিক করে উঠতে পারছে না। আমরা উজ্জ্বল নিশাচর, আমরা ভয় পাচ্ছি, দিনের আলো যেন ফুটে উঠতে আরো অনেক দেরি করে, আকুল হয়ে চাইছি। বিরাট পচা লেবুর মতো চাঁদটা আমাদের সঙ্গ দিক, আরো অনেকক্ষণ সঙ্গ দিক...”
“মাইরি! রূপকথা তৈরি করছিস না কি?”
“রূপকথা যে খুব ভাল ব্যাপার, তোকে কে বলল?”
“তোর রূপকথায় তো আমরাই থাকব, তাই না? ভাল থাকব আমরা দুজন মিলে।”
“এমন কোনো রূপকথা তুই শুনেছিস, যেটায় রাক্ষস নেই?”
“তুই ওই ছোরাটা এনেছিস কেন? আর লুকিয়ে রেখেছিস কেন?”
“কারণ কিছু গল্প সশস্ত্র হয়ে বলাই ভাল।”
“বন্ধুদের মধ্যেও?”
“হ্যাঁ। যেখানে বন্ধু কেবল দুজন- একজন গল্পটা বলছে, আরেকজন শুনছে।”
চূড়া রহস্য
“উন্মাদনা বা হতাশা ছাড়াও মানুষের আত্মহত্যা করার অনেকরকম কারণ থাকে। আরো খারাপ খারাপ ভয়াবহ সব কারণ।”
“যেমন?”
“একজন লোক জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই জঙ্গলের গভীরতম অংশে একটা গীর্জার চূড়া দেখতে পেল। সেটা দেখেই সে একটা খাদের দিকে গেল। ঝাঁপ দিল, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল তার শরীর।”
“সে কী! কেন!”
“এই যে তুমি ‘কেন’ শব্দটা বললে, তারপর লেখক একটা বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করবে, জিজ্ঞাসার চিহ্ন নয়। সেটা তুমি মেনে নিচ্ছ তো?”
“হ্যাঁ, আমি যতদূর বিস্মিত, ততদূর জিজ্ঞাসু নই।”
“একটা রহস্যের মুখে দাঁড়িয়ে সেটাই হওয়া স্বাভাবিক।”
“কিন্তু লোকটা খাদে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল কেন?”
“সেটার পিছনে দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ, যেহেতু ওর কাছে গলায় দড়ি দেওয়ার জন্য দড়ি ছিল না, সঙ্গে পিস্তল ছিল না, বিষাক্ত গাছ ও চিনত না, ওই একটা পথই ওর ছিল।”
“আর দ্বিতীয় কারণ?”
“ওই গীর্জার চূড়াটাকে বনের মধ্যে দেখে ওর নিজের উত্থিত লিঙ্গের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কিংবা, এমনও হতে পারে, ওই চূড়া দেখে ওর কোনো প্যাগান মন্দিরের কথা মনে পড়েছিল। লোকটা ছিল একজন ধর্মান্তরিত কট্টর ক্যাথলিক। ওর বাবা ছিলেন কোল সম্প্রদায় থেকে খৃস্টান ধর্ম নেওয়া লোক। ছেলেবেলা থেকে মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে ও খুব করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বাইবেল আর খৃস্টকে। জীবনে অজস্রবার কনফেশন বক্সে গিয়ে নতজানু হয়েছে, তবু শান্তি পায়নি।”
“তো?”
“তো, অদ্ভুত একটা বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ও ওই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারেনি।”
“প্রাণ দিয়ে দিল!”
“হ্যাঁ। যেহেতু মানুষ ঝাঁপ দ্যায় স্বপ্নের অন্ধকার বারান্দা থেকেই।”
এই তিনটি গল্প বহুদিন মনে থাকবে। মানব জীবনের গভীরতম অন্তর্ঘাতের কথা বলে শেষ গল্পটি। এত গোপনতম অনুভূতি বহন করে চলেছে এই গল্প যে, বলে বোঝাতে পারব না করুণ পরিণতি এই আমাদের শরীরের। চলতে ফিরতে শুনতে পাওয়া হাড়ের শব্দ। সর্বোচ্চ শিখরে গিয়ে নিজের গোপনতর অন্তর্গত চেতনাকে সম্মুখীন হতে শেখায় এই গল্প। প্রথম গল্পটি আমার কাছে প্রতিদিনের কাম ক্রোধের জীবন হয়ে ধরা দিল। গভীর আত্মকথন জীবনের পরম পাওয়ার কাছে সমর্পণ করতে গিয়ে আমরা অনেক সময়ই খুনি হয়ে উঠি। অযথা এ জীবন বয়ে বেড়ানোর যুদ্ধও জড়িয়ে থাকে এখানে পরপর শান্তি আর ঘৃণা ক্রোধ সবই একাসনে। ২য় গল্পটি চূড়ান্ত রহস্যময় ঠেকেছে আমার দু-জন মানুষের কথপোকথন কখন যে সশস্ত্র হয়ে ওঠে এটা আমরা নিত্য জীবনে খুব টের পাই। সন্ত্রাস।
ReplyDeleteসাঙ্ঘাতিক গল্প! তিনটি তিনরকম। শেষটার রহস্য সত্যিই চমকে দিল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। রূপকথা গল্পটি অসাধারন!
ReplyDeleteদুর্দান্ত
ReplyDeleteতিনটে অনুগল্পের শরীরে তিন ধারার রহস্যময় প্লট । অনুগল্পে এই প্রথম এত উচ্চমানের প্লট চোখে পড়ল। রহস্যময় অনুভূতি । সুন্দর পৃথিবীর কারণটা কী অদ্ভুত ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, পা মাড়িয়ে দেওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কে কেন্দ্র করে গভীর অনুরণন। যেন, সুন্দর পৃথিবী সুন্দর স্লিপার পড়ে আছে । রূপকথায় ছোরাটাই আসল রহস্য । এই ' কেন 'টা যেন সশস্ত্র লুকায়িত ।
ReplyDeleteসব থেকে ভালো লেগেছে ' চূড়া রহস্য ' । গির্জার চূড়াটাকে নিজের উত্থিত লিঙ্গ এর সঙ্গে তুলনা অসাধারণ । প্রাণ দেওয়ার কারণ হিসেবে যে মনস্তাত্ত্বিক দিক দেখানো হয়েছে তার রেস পুরো গল্পের শরীর জুড়ে প্লাবিত । ্্র্্্্র্্্র্্্্র্্র্্্্্র্্্্র্্্র্্্্র্্র্্
সত্যি পড়ার পর একটা অন্যরকম বোধ হচ্ছে। সবটা আমি প্রকাশ করতে পারছি না। প্রতিটি অনুগল্পেই একটা অনেক বড় লেখার বীজ লুকিয়ে আছে। আমার কাছে ১ থেকে ৩ অবধি ধারাবাহিকভাবে গল্পের মানের উন্নতি হয়েছে। তৃতীয় গল্পটি নিয়ে আমি বাক্রুদ্ধ। আশা করব অনুপম এরকম লেখায় মনোনিবেশ করবে। আমাদের পাওনাগণ্ডা বাড়বে।
ReplyDeleteওয়াও, গ্রেট
ReplyDeleteপ্রত্যেকটা গল্পই সুন্দর। এবং মনস্তাত্ত্বিকও।তিনটে গল্পই আলাদা স্বাদের।
ReplyDeleteDISTINCT
ReplyDeleteDISTINCT
ReplyDeleteDISTINCT
ReplyDeleteতিনটি গল্পই খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteরূপকথা অনেকদিন মনে থাকবে।
নমস্কার নেবেন আমার।
দুর্দান্ত.....
ReplyDeleteদুর্দান্ত.....
ReplyDeleteভাল গল্প
ReplyDeleteতিনটি গল্পই মারাত্মক সুন্দর । বিশেষ করে 'চূড়ার রহস্য' গল্পটির চিন্তা ও চেতনা একেবারেই অন্যরকম । সম্পূর্ণ ভিন্ন ডাইমেনশান । 'সুন্দর পৃথিবী' ও 'রূপকথা' গল্প দুটির চিন্তা আরেকরকম ভাবে এসেছএ । প্রকৃত অর্থে তিনটি গল্পই উৎকৃষ্ট মানের । প্রথম গল্পে 'শ্যামল' নামের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে কাহিনির দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠছে । কিন্তু শেষের গল্পটি দুটি অজানা চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়েও একটা অন্ধকার মানুষের মন ফুটে উঠেছে । অনবদ্য লেখনী ।
ReplyDelete।। শুভদীপ নায়ক ।।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteআমি একজন কম পড়াশোনা করা পাঠক বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারি, তাতে আমার লজ্জা নেই। সত্য বলতে লজ্জা কিসের? আমার কাছে প্রতিটি গল্পই কবিতার মতো মনে হয়েছে। অণুরণন দিয়ে ছেড়ে গ্যাছে। আমাকে
ReplyDeleteভাবাচ্ছে। গভীরে টেনে নিচ্ছে নিজের জানাশোনার পরিসর। প্রচন্ড দোলা দিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন ঘোর লাগে অমনি লাগছে।
প্রতিটা লেখাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে,'রুপকথা' গল্পটি খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteএগুলো কবিতা নয় কেন? এতো দারুন কবিতা। গল্পচরিত্র থেকে মনে হয় কবিতায় এরকম এক শ্বর ও স্বর কথা বলে ওঠে। আমার তো এগুলো নব আঙ্গিকের কবিতা সিরিজ মনে হলো। পিওর। স্বচ্ছতোয়া। অথচ কুহুকসঞ্চারী।
ReplyDeleteএমন লেখা নিজেকেও উৎসাহিত করে লেখার জন্য। প্রথমটি ও তৃতীয়টি দুর্দান্ত। লেখাগুলি দীর্ঘ রহস্যময় ভাবনার ফসল। অণুগল্প বিভাগে কেন? তিনটি গল্পই তো ছোটোগল্পই।
ReplyDeleteএ সত্যই অভিভূত করলো। অনুপম।
ReplyDeleteগল্পের ধারণা বদলে দিলে। তুমুল হয়েছে ।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteএমন গল্পগুলি আমাদের ভাবনার অতলে নিয়ে যায়।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteঅণুগল্প কাকে বলে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই । তাই অনুপমের এই ফিকশনগুলো পড়ে এতোদিন ভেবেছি যে ঠিক কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো । এর আগে কাজল সেন আমায় 'ঝুরোগল্প' লিখতে বলেছিলেন, সেটাও আমি বুঝে উঠতে না-পারায়, লিখতে পারিনি । তবে অনুপমের এই গদ্যগুলো পড়ে মনে হল যে এরকম রচনা আমিও পারব । অনুগল্প সম্ভবত পাঠকের সময়ের অভাবে জন্মেছে । কিন্তু ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা, তাকে অনুপমের গদ্যগুলো মান্যতা দিয়েছে । কিন্তু ছোটোগল্পের থেকে অনুপমের এই গদ্যগুলোর পার্থক্য হল, প্রতিটি রচনায় অনুপম এক-একটি দার্শনিক প্রশ্ন তুলে ধরতে চেয়েছে, যেগুলোর উত্তর সম্ভবত ও নিজেই সন্ধান করে চলেছে ; কিংবা নিজে জানে, এখন পাঠকদের সামনে তুলে দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে । অনুগল্পের ফর্মে নবায়ন করতে চেয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছি । এই ধরণের শর্ট-ফিকশন নিয়ে অনুপম যদি একটা বই বের করে তাহলে ওর দার্শনিক-প্রতিভার সঙ্গেও আমাদের পরিচয়ের সুযোগ হবে ।
Deleteঅণুগল্প কাকে বলে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই । তাই অনুপমের এই ফিকশনগুলো পড়ে এতোদিন ভেবেছি যে ঠিক কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো । এর আগে কাজল সেন আমায় 'ঝুরোগল্প' লিখতে বলেছিলেন, সেটাও আমি বুঝে উঠতে না-পারায়, লিখতে পারিনি । তবে অনুপমের এই গদ্যগুলো পড়ে মনে হল যে এরকম রচনা আমিও পারব । অনুগল্প সম্ভবত পাঠকের সময়ের অভাবে জন্মেছে । কিন্তু ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা, তাকে অনুপমের গদ্যগুলো মান্যতা দিয়েছে । কিন্তু ছোটোগল্পের থেকে অনুপমের এই গদ্যগুলোর পার্থক্য হল, প্রতিটি রচনায় অনুপম এক-একটি দার্শনিক প্রশ্ন তুলে ধরতে চেয়েছে, যেগুলোর উত্তর সম্ভবত ও নিজেই সন্ধান করে চলেছে ; কিংবা নিজে জানে, এখন পাঠকদের সামনে তুলে দিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে । অনুগল্পের ফর্মে নবায়ন করতে চেয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছি । এই ধরণের শর্ট-ফিকশন নিয়ে অনুপম যদি একটা বই বের করে তাহলে ওর দার্শনিক-প্রতিভার সঙ্গেও আমাদের পরিচয়ের সুযোগ হবে ।
ReplyDeleteভালো লাগলো।প্রথমের শেষ দুটো লাইন অনেকদিন মনে থাকবে।
ReplyDeleteভালো লাগল খুব
ReplyDeleteএই না হলে গল্প, পুরো লুটপাট করে নিয়ে গেল ভেতরটা।ঝাক্কাস...পুরো ঝাক্কাস।অনুপম দা... ভালোবাসা নেবেন।
ReplyDeleteদ্বিতীয় এবং তৃতীয় অণুগল্পদুটি ভীষণ ভাললাগল।প্রথমটাও বেশ।শুভেচ্ছা।
ReplyDelete