বিরক্ত হব নাকি হব না বুঝতে
পারছি না
অল্পবয়স, তবু
জড়িয়েছি। সকালবেলায় পরোটার থেকে ভাপ উঠছে। থইথই ক'রে
শাকসবজিতে ফুলে উঠছে রান্নাঘর। আর কিছুক্ষণ আগেই পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য উঠলেন।
প্রভাতী গানের নরম রশ্মিতে বিহ্বল করলেন আমাদের। ভাত হ'ল।
বাড়ন্ত। মাড় গড়িয়ে নামছে। বিরিঞ্চিনাথ পাহাড়ে মুখ থেকে ঝরনা। খেয়েদেয়ে মাদুর পেতে
শুতেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে এ'ল। পাহাড়ের গায়ে ছোপ ছোপ খুশি। সূর্য
আজকের মত চলে যাচ্ছেন কাল হয়তো আবার আসবেন। হয়তো নিভে যাবেন । আলো চলকে চলকে
পড়ছে ধানক্ষেতে। অল্পবয়স তবু জড়িয়েছি। পোশাক খুলছি আর পরছি। গতকাল খুব ভোরে
আসক্তির বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ বিড়বিড়
করেছিলাম। বিরক্ত হব নাকি হব না বুঝতে পারছি না। বিরক্ত হব নাকি হব না বুঝতে পারছি
না।
জোন বায়েজের গানের কয়েকটি
লাইন
১
সাধ মিটল না ৷ আশাও পূরণ হ'ল না। কিন্তু
সকলই এখনও ফুরিয়ে যায়নি। পরশুদিন বারবেলায় 'ডোনা, ডোনা ' শুনছিলাম। কী বিষণ্ণ, নরম
সুর। রান্নাঘরের চালা ফাঁকা ছিল না বলেই হয়তো উঠোনেই তিনটে শালিক ঝগড়া করছিল।
তাদের ঝগড়া দেখে আমার কবিসম্মেলনের কথা মনে পড়ছিল, অবশ্য
কাব্যমীমাংসার কোনো কোনো অনাবিষ্কৃত অধ্যায়ের সঙ্গে অদ্ভুত মিল যে আমার চোখে পড়েনি
এমনও নয়। রাজশেখর বোধহয় এই শালিকদেরই বয়সি। 'বাসাংসি
জীর্ণানি ' তাই অন্য বাস নিয়েছেন হয়তো কিন্তু এই বাস নেবার
সময় -- ' এ পরবাসে রবে কে ' গানটি কী
তাঁর মনে পড়েছিল রাজেশ্বরী দত্তের গলায়। কাব্যমীমাংসা বিষয়ে এইসব অমীমাংসার কথা
চিন্তা করছিলাম। নিৎসে সম্ভবত বলেছিলেন ঈশ্বরের মৃত্যুর কথা। এখন গীতার বিশ্বরূপদর্শনের
প্রসঙ্গে মনে হয় যে শ্রীচৈতন্যর দাদার নামও ছিল বিশ্বরূপ। এই যে একটি বিক্ষিপ্ত
চিন্তা আপনাকে আরও কোটি কোটি চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে, এবার
আপনি প্রতীত্যসমুৎপাদ ভাববেন নাকি বারবেলায় ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুম দেবেন তা আপনার
ব্যাপার। কিন্তু চিন্তাশূন্য হবার কথা আবার বোধিধর্ম বেশ জোর দিয়ে বলেছিলেন বোধহয়।
তাই হয়তো সকলই ফুরিয়ে ফুরায় না। আমাদের করোটির খটখট শব্দে আর রহস্যময়
চক্রানুষ্ঠানে বসেছেন যিনি, তাঁর মুখে তপ্ত পঞ্চাগ্নি আর
চোখে পথ না ফুরানোর নয়নপথগামী ডাক। অবশ্য বায়েজের গাওয়া ' ফাইভ
হানড্রেড মাইলস ' গানটি নিয়েও কতভাবে ভাবা যায় যেহেতু,
তাই সকলই যে ফুরিয়ে এখনও যায়নি মা এ তো জলবৎ স্বচ্ছ আর আকাশবৎ
সুবিশাল।
২
জোড়া-শিবমন্দিরের চাতালটা
মনে পড়তেই মনে হ'ল আর কোথায় কোথায় জোড়া-শিবমন্দির আছে, আর কোথায় চাতাল।
অথবা তিনিই আর কোথায় আছেন যাঁর বাইকের পিছনের শিটে বসে জোড়া-শিবমন্দির দেখেছিলাম
আমি। ভেতরেও যা তা নাকি বাইরেও। তবে কী চাতালের ভেতরেও চাতাল আছে, শিবের ভেতরেও শিব। শিবের ভেতরেও শিব আছেন, এমন
অলুক্ষণে কথা দীর্ঘক্ষণ ভাবব না বাবা, ঠাকুর আমাদের শিখিয়ে
দিয়েছেন ' ভক্তের আমি ' রাখা চাই। সেই 'আমি ' রেখেই বরং চাতালের ওপর বসি । চাতালের ভেতর
চাতাল। আমার ভেতরও আমি। উফফ বড়ো গোলমেলে ব্যাপার, তবে কী
রসগোল্লার ভেতর আরও রসগোল্লা হাতড়াব আমি অথবা আঙুল তুলে বলব ' শুভাশিস'দা তোমার ভেতরের জনকে দেখতে পাচ্ছি '
কিন্তু তাঁর সঙ্গে তেমন আড্ডা জমছে না যেমন জমছে বাইরের তোমার সঙ্গে
জোড়া-শিবমন্দিরের বাইরের চাতালে।
৩
রানুকে লেখা ভানুদাদার
চিঠিগুলি অসুখের শুশ্রূষা। ছায়াসুনিবিড় শান্তিরনীড়ে বসে লেখা সে'সব চিঠি
ভোরবেলাকার আদর অথবা ঘুম ভেঙে ট্রেনের জানালার সকাল অথবা কন্যকার গায়ে বাবার
স্নেহস্পর্শ। খুব ভালো দিন কাটছে। বিভূতিভূষণের মহৎ আশ্রয়ে গ্রামজীবনের ডাকে রেলের
সুদূর গুঞ্জরনে নিজেকে মাঝে মাঝে একইসঙ্গে অপু - দুর্গা মনে হয়, আবার মাঝেমধ্যে রানু আর ভানুদাদাও।
৪
মরে যাবার কয়েকবছর আগে থেকেই
তাঁর এমন দুরবস্থা যে কাপড়েচোপড়ে পায়খানা ক'রে ফেলে খালি আর সবাই যা তা বলে যায়।
শেষে হাড়ের আদলের ওপর চামড়ার ফিনফিনে খোলশটুকুই তাঁর সম্বল ছিল। শীতের শেষে
বটগাছের পাতাও ছিল একটিমাত্র আর ছিল দৃশ্যবাস্তবতার বাইরে অজস্র সম্ভাবনা।
৫
পরশুদিন মাঝরাতে তত্ত্বের
দিকে পিছন ফিরে শুয়েছিলাম,
মুখ জীবনের দিকে করে৷ আকাশে হালকা হালকা বিদ্যুৎচমক। জীবন জুড়ে
অনাবশ্যক কামড়াকামড়ি। হাড়হাবাতের শীৎকার। কয়েক টুকরো কমলা রঙের রোদ। এই
বৈচিত্র্যময় সহাবস্থান ছেড়ে তত্ত্বের দিকে মুখ ফেরাইনি। প্রজ্ঞার ভারে ন্যুব্জ কেউ
একজন চোখা চোখা বাণী দিচ্ছিলেন। দলে টানতে চাইছিলেন। আমি খুব ভোরে তিনি ওঠার আগেই
বাড়ি ছেড়ে স্বস্থানের দিকে পালিয়েছিলাম। তত্ত্ব এখন উঠে আমার চিরশূন্যকে প্রত্যক্ষ
করছেন, আর যেদিকে আমি পালালাম তার পুইপালংজড়ানো দিগন্তের
উল্টোদিকে তাঁর বিবিক্ত মুখ থেকে ধোঁয়া উঠছে।
মারাত্মক লেখা শুভম।। আবহমান বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্য দর্শন গান — কতকিছু আত্মসাৎ করে তৈরি হয়েছে এই লেখা।। ভালোবাসা জানাই এমন হাতকে৷— প্রীতমদা
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ । খুব আনন্দ পেলাম।
Deleteঅনুভূতির প্রতিমা যেন! ভালোবাসা...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
Deleteখুব ভালো লাগল
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদুরন্ত লিখেছ ভাই
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
Deleteঅদ্ভুত রে ❤
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
Deleteভাল লাগলো
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
Deleteজোন বায়েজের গানের কয়েকটি লাইন অসামান্য।
ReplyDeleteঅনেক ভালোবাসা রইল।
ভালোবাসা রণজিৎ'দা
Delete"হাড়ের আদলে চামড়ার ফিনফিনে খোলস"!!! এইরকম ছবি, এত আশ্চর্য সব ইমেজের অনায়াস অথচ সহজ খেলা, যা এই প্রতিটি লেখায় পেলাম, খুব বেশী পাই নি। খুব ভালো লেখা
ReplyDeleteভালোবাসা সুমনা'দি।
Delete"হাড়ের আদলে চামড়ার ফিনফিনে খোলস"!!! এইরকম ছবি, এত আশ্চর্য সব ইমেজের অনায়াস অথচ সহজ খেলা, যা এই প্রতিটি লেখায় পেলাম, খুব বেশী পাই নি। খুব ভালো লেখা
ReplyDeleteখুব আনন্দ পেলা৷
Deleteসাধু সাধু,দারুণ লাগল রে! গভীর ও ব্যাপ্ত। অন্যরকম লিখছিস। লিখে যা।
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDeleteপ্রথম কবিতায় বাড়ন্ত শব্দটির ব্যবহার পছন্দ হয় নি। কেননা বাংলা বাগধারায় ওই শব্দটির অর্থ অনেক সময় নিঃশেষিত। বিশেষ করে চাল ও ভাতের অনুষঙ্গে যখন বলা হয়। আপনিও সে রকম করতে গিয়ে ওর আবিধানিক অর্থটিকে মনে হয় খেয়ালে রেখেছিলেন। তাই বাক্যের ব্যবহার ওটা সঠিক প্রয়োগ হয় নি। শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteকী জানি আমার তো তা মনে হয়নি। আর সচেতন মনের ওপারেও যে মন সেখানে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কার সংগ্রথিত। এই কবিতায় বাড়ন্ত শব্দটি নিতান্ত শব্দই নয় এটি বিশেষ অভিপ্রায় চিহ্নিত। শূন্য পূর্ণের একটা কূটাভাস সম্ভবত আছে বাড়ন্ত এবং ঝর্ণা থেকে মাড় গড়িয়ে নামার উপমায়। বাকি পাঠক নিজস্ব একক বিনির্মাণে বুঝে বা না বুঝে নিন। ধন্যবাদ।
Deleteপ্রথম কবিতাটি খুব ভালো লাগল। মনে হচ্ছিল, পড়তে পড়তে তীব্র এক আলোর বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করছে।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ। ভালো থেকো।
Deleteসিরিজ কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। এত ভালো।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
ReplyDelete