বাক্‌ ১৪৪ ।। তপোভাগ ।। পঞ্চদশ পর্ব : বিদর্ভ ।। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বিদর্ভ

যুদ্ধটা জিতে ভোজবংশীয় নৃপতি জ্যামঘ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এ যুদ্ধ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে হবে বলে ভাবেননি। ভোজবংশীয়রা এমনিতে রাজ্যবিস্তারের জন্য যুদ্ধ পছন্দ করে না। যেটুকু রয়েছে রাজ্য তা যথাসাধ্য পাশের দিকে বাড়াতে হবে, অন্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে নিজরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে সেই নৃপতিদের নিজের অধীনে সামন্ত বানাতে হবে, মথুরার ভোজবংশীয়েরা এই নীতিতে চলেনা। মথুরায় রাজ্য-রাজত্ব ব্যবস্থাটিই অন্য। কিন্তু মথুরা থেকে নাতিদূর দক্ষিণে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া অতীতের যদুবংশীয় যুবকের বর্তমান যুবক পুত্র জানেন, এখানে মথুরার নীতিতে চললে হবেনা। তাঁর রাজ্যটি তেমন ক্ষুদ্র নয়, যে আলগা বাতাসে উড়ে যাবে কিন্তু ততো বৃহৎও নয়, ঝড়েও উড়বেনা। তাই তাকে বড়ো করা প্রয়োজন। প্রয়োজনমতে তাই, মাঝেমধ্যে যুদ্ধযাত্রা করতে হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধটিতে চিন্তার বিশেষ কিছু ছিলোনা বলে চরেরা জ্ঞাপন করেছিলো। সচরাচর বৃহৎ রাজ্যের আক্রমণের সম্ভাবনায় ক্ষুদ্রতর রাজ্যগুলি অকারণ শক্তিক্ষয় না করে মস্তক নামিয়ে নেয় এবং বৃহৎ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এখানেও তেমনই হবে, মাঝখান থেকে কিছু উপঢৌকন পেয়ে ফেরার পথে কয়েকদিন মৃগয়া করে ফিরবেন ভেবেছিলেন ভোজরাজ জ্যামঘ।কার্যকালে সে ক্ষুদ্র রাজ্য নতিস্বীকার করলোনা, প্রতিরোধ করলো, এবং মাঝপথে গিয়ে জ্যামঘ সমস্যায় পড়ে গেলেন।  তার বাহিনী পিছু হটে না। বলাই আছে, পেছিয়ে এলে মৃত্যু, পালালে নির্বাসন। সৈন্যরাও জানে, জেতা ছাড়া পথ নেই। মহারবে সামনের শত্রুকে কাটতে কাটতে এগোয় তারা, শত্রু বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। এখানে শত্রুপক্ষ জলের আশ্রয় নিয়েছিলো, জলযান ব্যবহার করতে তারা পটু, তাই জ্যামঘ তাঁর বাহিনীসুদ্ধু উচ্ছিন্ন হবার জো করেছিলেন। পরে, একজন সাধারণ পদাতি এক বুদ্ধি দিলো, তা ব্যবহার করে জ্যামঘ যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, পদাতিটির অচিরেই পদোন্নতি হবে, বিজিত নৃপতিটি প্রধানতঃ আরণ্যক গোষ্ঠীর, ধনসম্পদ বিশেষ কিছু পাওয়া গ্যালোনা বলে সেই বিজিত নৃপতির বালিকা কন্যাটিকেই নিয়ে চলে এলেন জ্যামঘ। দীঘল চেহারার গৌরাঙ্গী কন্যাটির পিতাটি নিজেকে দনুবংশীয় বলে গর্ববোধ করেন। দনুবংশীয়ের সেই মস্তক পরাজয়ে নত করা গেছে বলে জ্যামঘ শ্লাঘা বোধ করছিলেন। ফিরবার পথে কন্যাটিকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন সেটি আসলে বালিকামাত্র, বড়সড়ো চেহারা দেখে যুবতী হয়ে উঠতে চাওয়া কিশোরী মনে হচ্ছিলো। এখন, এ দুগ্ধপোষ্য বালিকাকে নিয়ে তিনি কি করবেন? যদি উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরীও হতো, গান্ধর্ববিবাহ সেরে নিয়েই তিনি রাজধানীতে ফিরতে পারতেন। সেও তো এখন সম্ভব নয়, ওদিকে ঘরে রয়েছেন প্রখরা শৈব্যা। পশুপতি মহাদেবের প্রবল ভক্ত, অখণ্ড পতিপরায়ণা এবং প্রখর মুখরা শৈব্যা। উঃ শৈব্যা দিনে দিনে এমন হয়ে উঠলো, যখন এসেছিলো, তখন এত বেশি বিকশিত ছিলোনা তাঁর ব্যক্তিত্ব। জ্যামঘ সে কম বয়সের দূর্বলতায় পত্নীকে দিনে দিনে মস্তকে তুলেছেন, এখন আর তা নিরাকরণ করার পথ নেই। যদিও শৈব্যা অতি পতিভক্ত, জ্যামঘ তাঁর কাছে স্বর্গ, তাই সেই স্বর্গের সামান্য ক্ষুদ্রতম অংশও তিনি অন্য কাউকে ছাড়তে সম্মত নন।

 

অথচ নৃপতিদের তো একাধিক পত্নী থাকেই। নৃপতিদের কেন, সংসারে যে কোনো প্রতিষ্ঠ পুরুষেরই থাকে। জ্যামঘ একজন নৃপতি, ক্রমশঃই তাঁর রাজ্যটি বড়ো হচ্ছে, কয়েকটি রাণী না থাকলে তাঁকে মানায়? অথচ শৈব্যা! বিশেষতঃ তাঁর ক্রন্দন ও চোখের জল...  উঃ!

 

দনুবংশীয়া বিশালাকৃতি সেই কন্যাকে নিয়ে রাজপুরীতে ফিরে জ্যামঘ আর এক প্রস্থ সমস্যায় পড়লেন৷ এতক্ষণ যেসব সমস্যা চিন্তার স্তরে ছিলো, তা এসে গেল বাস্তবে। শৈব্যাকে তিনি কিছুতেই বোঝাতে পারেন না, যে, পরাজিত নরপতির থেকে উপঢৌকন না নিলে বিজিত নৃপতির মান থাকেনা, আর এই দনুজ নরপতির আর কিছুই দেবার ছিলোনা, এই কন্যাটি ছাড়া। উপঢৌকন পাওয়া কন্যারত্নটি তিনি অন্য কাউকে দিয়ে দিতেই পারতেন। সেই পদাতিকে দেননি কেন, যার বুদ্ধিতে জয়লাভ হয়েছে? নৃপতির উপঢৌকন অন্য কাউকে দেওয়া হয়তো যায়, কন্যারত্ন যায় না? নৃপতির কন্যা অপর নৃপতির গৃহে দাসী হলেও চলে, কিন্তু সাধারণ কোনো প্রজার পত্নী হতে পারে না, এমন কোনো নিয়ম আছে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, যুদ্ধজয়ের পর গৃহে ফিরে বর্ম কবচ খুলতে সময় পাননি জ্যামঘ, অস্ত্রাদি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পত্নীকে বললেন, ওই কন্যা আমি তোমাকে দান করলাম, তুমি ওকে নিয়ে যা খুশি করো, এখন দয়া করে আমার হাত পা শীতল জলে মোছাও, অথবা দাসীদের অনুমতি করো।

  সঙ্গে সঙ্গে রাণীর আদেশে এসে গেলো সুগন্ধী উদক ও কার্পাস। জ্যামঘের সেবার অনুমাত্রও শৈব্যা অন্যদের হাতে দিতে চান না, দাসীদের হাতে তো নয়ই। প্রবলপ্রতাপ নরপতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

  সেই উপদানবী কন্যাকে শৈব্যা কন্যাস্নেহে পালন করতে লাগলেন। বছর ঘুরতে কোলে পুত্রসন্তান এলো, শৈব্যার। নাম রাখলেন, বিদর্ভ।

যে কন্যাকে নরপতি জ্যামঘ নিজে বিবাহ করবেন বলে এনেছিলেন, কালক্রমে সেই উপদানবী কন্যার সঙ্গে বিবাহ হলো জ্যামঘের সেই পুত্র বিদর্ভের। তাদের দু'টি পুত্রসন্তান জন্মালো। ক্রথ ভীম ও কৈশিক।

ইতিমধ্যে কাল পেরিয়েছে বহু। আপন পুত্রের নামে সৃষ্ট রাজ্যটিকে যথেষ্ট বড়ো করার পর নৃপতি জ্যামঘ মন দিয়েছিলেন সেই রাজ্যে মথুরার মতো শাসনব্যবস্থা প্রচলন করার। বিশাল বিদর্ভ রাজ্যের প্রান্ত প্রান্ত থেকে তিনি ভোজ অন্ধক বৃষ্ণিবংশীয়দের তুলে এনে কূলমূখ্য বানিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন মথুরার মতো এক শাসন পরিষদ। সেখানে পরিষদের কথা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, যদিও রাশ ধরে রাখা ছিলো নৃপতি জ্যামঘের হাতেই।

  কিন্তু তা ততোদিন, যতোদিন জ্যামঘের জীবৎকাল। যে পুরুষ প্রায় একার হাতে গড়ে তুলেছেন এমন এক বিশাল সুদৃঢ় রাজ্য, তাঁর ব্যক্তিত্বে একটা কিছু থাকে, যাতে তাঁর বিপক্ষে ধূমায়িত হতে পারেনা জনমত। কোষাধ্যক্ষ ও সেনানায়করা বিনাপ্রশ্নে জ্যামঘের অনুবর্তী ছিলেন। কিন্তু তাঁর পুত্র বিদর্ভের সে ব্যক্তিত্ব ছিলোনা। তিনি বসে বসে রাজ্যটি পেয়েছিলেন, শুধুমাত্র রাজত্ব করতে শিখেছিলেন, রাজ্য টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত যে সংঘাতময় চর্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, সে বিদ্যার উত্তরাধিকার পিতার কাছ থেকে তিনি পাননি। তাঁর রাজত্বকালে শিথিল হতে থাকলো পারিষদদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। ইতিমধ্যে পারিষদদেরও প্রজন্ম পাল্টেছে। জ্যামঘ স্বয়ং যাকে যাকে হাত ধরে তুলে এনেছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা ছিলো,  জ্যামঘের প্রতি হৃদয় ধাবিত হতো তাঁদের। পরের প্রজন্ম সেই কৃতজ্ঞতার উত্তরাধিকার ততো বহন করেনা, নৃপতি বিদর্ভের অনুচর বলে নিজেকে গণ্য করতে কারো কারো মানে লাগে। মথুরা রাজ্য থেকে দক্ষিণে, মথুরারই যেন কোনো বিশালায়তন সন্তান এই বিদর্ভ রাজ্য, নৃপতি জ্যামঘের বেঁধে দেওয়া বিধিবলে সুদৃঢ় এই রাজ্য, এবং স্বভাবতই, বড়ো ও সমৃদ্ধ রাজ্যে যা হয়, রাজপরিষদে শুরু হয় মন্ত্রণার ঘূর্ণাবর্ত।

জ্যামঘের পর নৃপতি বিদর্ভ, বিদর্ভের পর ক্রথ ভীম। কিন্তু ভীম এক বিশালদেহী বীর হলেও রাজত্ব করতে গিয়ে নানাবিধ ভুল করতে থাকেন। ফলে পারিষদদের সম্মতিক্রমে বিদর্ভের অপর পুত্র কৈশিককে রাজপদে বসানো হয়। কৈশিক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনিও সর্বত্র সফল হতে পারলেন না। পারিষদদের মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকলো অসন্তোষ, স্থানে স্থানে প্রজাবিদ্রোহও হলো এমনকি। পরে উপায়ন্তর না দেখে পারিষদরা একটি কিশোরকে রাজপদে বসালেন। তার আগে অব্দি সেই কিশোর ছিলো এক আপাত স্তিমিত ব্যক্তি, সিংহাসনে আসীন হয়ে তার রূপ বদলে গেল। দৃঢ়হাতে দমন করলো বিদ্রোহ, সৈন্যবাহিনীকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে মূল ভাগটি রাজধানীতে রেখে অন্যগুলিকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে চরতে পাঠানো হলো। হ্যাঁ, চরতে। কোথাও এক দিবসের বেশি অবস্থান করবেনা তারা, সমগ্র রাজ্যটিতে ঘুরে বেড়াবে, অশান্তি দেখলেই দমন করবে। প্রজারা শান্ত হয়ে আপন কাজে মন দিলো। অন্যান্য সমস্যাগুলি যেন ইন্দ্রজাল প্রভাবে দূর হয়ে গেল।

 ফলে, সেই কিশোরই রয়ে গেল রাজপদে। ক্রথ ভীম ও কৈশিক, বিদর্ভপুত্র দুইভাই ভেবেছিলেন এই নাবালকটি আর কদ্দিন, রাজসিংহাসন তাঁদের হাতেই আবার ফিরে আসবে। অথচ রাজপদে প্রোথিত হয়ে বসে রইলো সেই নাবালক কিশোর। বুকে হাহুতাশ জাগিয়ে রেখে, চোখে আগুন জ্বালিয়ে রেখে সেই নাবালকটিকে আপন পিতার নামাঙ্কিত রাজ্যে শাসন করতে দেখেন ক্রথ ভীম আর কৈশিক।

কিশোর নৃপতির নাম ভীষ্মক। সে অবশ্য রাজ্যটির বিদর্ভ নামই রেখেছে। সে জানে, নাম পাল্টালে লোকে তা পছন্দ করবে না। রাজ্যের নামটির সঙ্গে বহু মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। নাম পাল্টেই বা লাভ কি হয়? বিদর্ভ নামই থাকুক না? বিদর্ভপতি বিদর্ভর পুত্রদুইটি অপদার্থ, রাজ্যটিকে উৎসন্ন দিতে বসেছিলো। তাঁরা রাজবংশীয়ের যা যা মর্যাদা তা নিয়ে থাকুন না কেন! রাজত্ব করার দায়িত্ব ভীষ্মক নিজের কাঁধে নিয়েছেন। চতুর্দিকে শত্রু। পূর্বে জরাসন্ধ, উত্তরে হস্তিনাপুর ও পাঞ্চাল রাজ্য, দক্ষিণে অগণ্য আরণ্যক উপজাতি, দক্ষিণ-পূর্বদিকে মণিপুর রাজ্য, উত্তরপূর্বে কিরাত দেশ, কিছু না হোক, চতুর্দিকে নাগবংশীয়েরা ছড়িয়ে আছে। এসব সামলে রাজ্যটিকে সঠিকভাবে চালনা করতে হবে। দিনকাল কিছুই আগের মতো থাকছেনা, রাজ্যও আগের মতো নেই, রাজ্যবাসীও আগের মতো নেই বিদর্ভরাজের পুত্ররা এই রাজ্য সামলাতে পারবেননা। ওঁরা রাজবংশীয়ের প্রাপ্য সুখভোগ করুন। রাজ্যটি চালনা করার দায়িত্ব ভীষ্মক নিজের স্কন্ধেই রাখছেন।

No comments:

Post a Comment