অনন্ত যাত্রা
সোমবার বাড়ি থেকে সাততাড়াতাড়ি বেরোবার একটাই কারণ— বাসে পছন্দের সিট পাওয়া। শুনলে যে কারওর মনে হবে— মিনিংলেস! তাতে আপত্তি করার মতো কিছু নেই প্রতাপের। ওর জীবনের বেশিরভাগ জিনিসেরই বিশেষ মানে নেই। কাউকে কনভিন্স করাতেই প্রতাপ ব্যর্থ। ছোট থেকে ঘরে-বাইরে সব জায়গায় ‘না’ শুনে সব ইচ্ছেই শুকিয়ে গেছে বলে মনে হয়। অফিসে ওকে সবাই ‘না’-বাবু বলে ডাকে। কেননা যে কোনও ব্যাপারেই কোমরে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে না বলাটাই প্রতাপের দস্তুর। সবাই হাসাহাসি করে। তবে কেউ ঘাঁটায় না বেশি, এড়িয়ে চলে বেশিরভাগ লোক।
আজকাল নিজের
নামটাকেই বড় ফ্যালাসি বলে মনে হয় ওর। ‘এর’ম মিনমিনে ছেলের নাম প্রতাপ!’ কৈশোরে শোনা একথাটা মনে পড়লে এখনও গা রিরি
করে ওর। জীবনের বেশিরভাগ
ব্যাপার যে অনাবশ্যক সেটা বুঝতে পেরে অবশ্য কিছুতেই ও গা করে না আজকাল। এখন যেমন প্রতাপের মনে হচ্ছে— সোমবার সকালে
কানে হেডফোন লাগিয়ে আলতো হাওয়ায় বাসের জানলাটুকুই এখন ওর জীবনের একমাত্র
ইন্সেন্টিভ। বাকি সবকিছু হয়ে
দাঁড়িয়েছে বারবার ফোটানো চায়ের মতো বিস্বাদ।
প্রতাপ বসে
বসে এক মনে ভাবতে থাকে কর্পোরেট না হলে এই একটা সমস্যা, আশপাশের লোকগুলোকে কির’ম যেন
গেঁয়ো প্রকৃতির মনে হতে থাকে। সবাই যেনতেনপ্রকারেন তাকে ওরা নিজেদের মতো করে ট্রিট করতে চায়। তখন তাদের মাথায় থাকে না, অফিসের আরজেন্ট কোনও
দরকারে টানা বারো ঘণ্টা একনাগাড়ে কাজ উতরে দেওয়ার ক্ষমতা প্রতাপ ছাড়া কারও নেই। যদিও সেটা ক্লারিক্যাল কাজ... তবু কাজ তো! লোকে
যেন টেকনিক্যাল কাজ ছাড়া কোনও ব্যাপারকেই গুরুত্ব দিতে চায় না— কথাটা মনে পড়তে কাউন্টার
যুক্তি ভাবতে থাকল প্রতাপ। মনে হল, দুনিয়ায় সভ্যতার সিংহভাগ ইতিহাস তো কেরানির হাতেই রচিত। ভাবতে ভাবতে আবেশে চোখটা একটু লেগে এসেছিল
বোধহয়।
হঠাৎ একটা
ঠেলায় চটকা ভেঙে গেল। ওর ঠিক পাশেই একটা মাঝবয়েসি লোক। লোকটা মুখটাকে যথাসম্ভব বিনীত করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। প্রতাপ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে লক্ষ্য করল লোকটার
পাশে একটা আলগা চটকওলা মেয়ে। লোকটার খোঁচা খোঁচা গোঁফের ফাঁক দিয়ে বেরোনো কথাটা বুঝতে পারল— সেই এক আবেদন,
জানলার ধারের সিটটা ছেড়ে দেওয়া। এটা ওকে প্রায়ই ফেস করতে হয়। প্রতাপ বুঝতে পারল খানিকটা অবাক হয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আজ আর টেটিয়ার মতো ব্যবহার করতে ইচ্ছে করল না,
সরে আসার পরিবর্তে কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটার তাকানোতে মনে হল ‘কোথায় যেন দেখেছে’। একথা শুনলে সবাই বলে এই অনুভূতিটা ত্রিশ পেরোনো
সব ছেলেরই হয়।
ও সবসময় মনে
করতে না পারলেও বুঝতে পারে একটা বেশ বড় প্রশ্ন যেন ওর মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। মাঝেমাঝে মাথার মধ্যে কোন দূরাগত কথাবার্তা
বেজে ওঠে। প্রতাপ জানে, এসব
কথা লোককে বলা যায় না। বললে সবাই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলবে। কিন্তু ওর কাছে যেটা সত্যি— সেটাকে
নিজে কী করে অস্বীকার করবে? যদিও ভেবে কোনও কুলকিনারা পায় না... বুঝতে পারে না ঠিক
কোন হিসেবে ওর জীবনে ওর’ম অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়েছিল!
লোকটা
ততক্ষণে বেশ বিগলিত মুখে টুকটাক কথাবার্তা শুরু করেছে। তবে বসার ব্যবস্থাটা একটু বিসদৃশ হয়েছে বলেই
মনে হল প্রতাপের। জানলাটা ছেড়ে ও
দু’নম্বর সিটে বসেছে। একদিকে মেয়েটা, আর-একদিকে তার বর। কথাবার্তায় প্রতাপ বুঝেছে কিছুদিন হল এদের বিয়ে হয়েছে। লোকটা জানিয়েছে প্রতাপের মেস আর ওদের বাসা
কাছাকাছি। আকারে-ইঙ্গিতে
প্রতাপ বুঝেছে লোকটাকে দেখতে এর’ম মরকুট্টে হলেও বেশ অবস্থাপন্ন। এখন ফিরছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। লোকটা কলকাতা বললেও প্রতাপ জানে জায়গাটা আসলে
বৃহত্তর কলকাতার অংশ। যদিও সেসব নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই কারণ ও নিজেই সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা ছাড়া বাকি
সময় কাটায় পঞ্চায়েত এলাকায়। সুতরাং শহর-গ্রাম, ফরসা-ময়লা, আলো-আঁধার নিয়ে ব্যাগেজ বয়ে বেড়াবার কোনও মানে
হয় না।
ঐতিহাসিকভাবে
স্বীকৃত বাঙালি কেরানিদলে প্রতাপ অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে ওর যে বিরাট মেন্টাল সেটব্যাক
হয়েছিল তা নয়। বরং ক’ বছরের বেকার
দশা কাটিয়ে ও মনের দিক থেকে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গেছে ততদিনে। তার আগের কয়েক বছরে বায়োলজির তত্ত্ব নিয়ে তার
নাড়াঘাঁটা করার স্মৃতিও মুছে এসেছিল পরিস্থিতির চাপে। তাই মফস্সলের এর’ম একটা অফিসে মাছিমারা কেরানি
হওয়াটাকে মেনেই নিয়েছিল প্রতাপ। যদিও মাঝেমাঝে মনে হত— মেসে থাকা অন্যদের থেকে ও
আলাদা। বেশভূষা চলনবলন ও
মেজাজের কারণে অন্যরাও ওকে খুব সুনজরে দেখতে না।
এই মেয়েটাকে
যে চেনা মনে হচ্ছে সেটা সত্যি। মাথার মধ্যে কে যেন বলছে— এই মেয়েটাই! এর জন্যই এত পথ ঘুরতে হয়েছে। আবছা আবছা মনে হচ্ছে কী যেন একটা জটিল জেনেটিক
সংকেত তাদের মাধ্যমেই প্রাণ পাবে। মাথার ভেতর এসব শুনতে শুনতে চোখটা আবার লেগে
আসছে বলেই হয়তো প্রতাপের মনে হল মেয়েটার নাম রাই। নামটা কি একটু বেমানান হয়ে গেল? তারপর প্রতাপ
নিজের মনেই বলল, এই তো ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুর... রাই ঠিকই আছে। বরটাই বা কি একেবারে কানাইকুমার!
২.
কলেজে প্রতাপের বিষয় ছিল জুলজি। ও ডাক্তার হতে চেয়েছিল কিন্তু জয়েন্টে পায়নি। তাই অগত্যা বায়োলজিকে ভালবেসে জুলজি পড়া। সেকেন্ড ইয়ারে এসকারশানে কলেজ থেকে চাঁদিপুর
যাওয়া হয়েছিল। আর সবার মতো কিছু সি লাইফ সংগ্রহ আর মূলত আড্ডা-ঘোরাঘুরি। সারারাত হুল্লোড়ের পর সবাই শুতে গেলেও মাথায়
একটা ভোঁতা ব্যাথার মতো অস্বস্তি নিয়ে প্রতাপ বেরিয়ে পড়েছিল। তখন আলো বিশেষ ফোটেনি। সমুদ্রও অনেকটা পিছিয়ে গেছে। ফলে লোকজন বিশেষ নেই। দিগন্তবিস্তৃত সৈকতে অলস
পায়ে হাঁটছিল প্রতাপ। একটা জায়গায় দেখল বেশ কিছু কাক আর পাখিদের জটলা। কিছু ভেসে
এসেছে কিনা দেখার জন্য এগিয়ে গিয়ে প্রতাপ অবাক হয়ে দেখেছিল অতিকায় পাখির মতো কিছু
একটা বালিতে মাখামাখি হয়ে ছটফট করছে। আরও কাছে গিয়ে মনে হল ঠিক পাখি নয়, মানুষের
মতোই কিছু। তার শক্তিশালী ডানা
মাঝেমাঝে ঝাপটাচ্ছে। প্রাণীটা যেন কাতরাচ্ছে কোনও অজানা ভাষায়। প্রতাপের মনে হয়েছিল যেন টিউন না হওয়া রেডিয়োর
মতো ঘসঘসে শব্দ। মানুষের মতো গড়ন— পিঠে ডানা... নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে
পারছিল না প্রতাপ। এই প্রাণীর বায়োলজি সম্বন্ধে তার কোনও ধারণা নেই। কারওরই নেই। বড়জোর পৌরাণিক কাহিনি অনুসরণ করে কল্পনা করা
যায় মাত্র। আর বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারেনি ও। প্রাণীটার কাছে ছুটে গিয়ে
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো একটা অনুভূতি সঙ্গে মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। চোখে অন্ধকার দেখল প্রতাপ। মনে হল পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে। কিন্তু
ভেতরে জ্ঞান ছিল পরিস্কার। সেই ঘসঘসে রেডিয়োর কণ্ঠস্বরে প্রতাপ বেশ পরিষ্কার বাংলা শুনতে পেল তারপর।
যথাসম্ভব উত্তরও দিল...
—তোর জন্যই
এই সমুদ্রের আশপাশে ওড়াউড়ি করে ভিজে নোনা হাওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে। এতটা পথ এসে তোকে খুঁজে বের করা কি সোজা কথা?
—মানে আমাকে
খোঁজাখুঁজি কেন? আর এই উৎপটাং চেহারা নিয়ে কোথা থেকে এলে কমরেড
—সে
বেত্তান্ত তোর মতো গবেটের খুপরিতে ঢুকবে না... অনেক অরবিট পেরিয়ে টাইমজোন ঘেঁটে
আসতে হয়েছে। কারণ হেড কোয়ার্টার
তোদের মতো ঢ্যামনাদের এবার তুলবে ঠিক করেছে।
—কোথায়
তুলবে, আমি তো পড়ে আছি।
—সারারাত
ধরে বাংলা ইংরিজি একসাথে খেলে পড়বি না তো কী হবে...
—বাতেলা কোরো
না তো... তুমি কে হে বাল...
—তোরা কী
বুঝবি... যুগ যুগ ধরে বড়-বড় লোকের কাছে খবর আনছি... তাদের আপ্যায়নও ছিল বটে,
রাজকীয় ব্যাপার
—আসল কথাটা
বলবে তো...
—দেবদূত বলে
যাকে... মহাকাব্য তো আর পড়িসনি।
—ওরে আমার
দেবদূত রে... হেগেমুতে একেক্কার... বালিতে ডানা ঝাপটাচ্ছে
—ইয়ার্কি
ছাড়... কথা হল তোর সাথে যোগাযোগ করা... বাকিটা তারা বুঝে নেবে কখন কী করতে হবে...
আমার ওপর অর্ডার করেই তো সব খালাস, এদিকে ইনক্রিমেন্টের নাম নেই...
—কিন্তু
যোগাযোগ হল কী করে... আমার পেছনে কি ইউএসবি গুঁজে দিয়েছ নাকি!
—ওরে গবেট
বুঝছিস না... তোর সাথে যোগাযোগ না হলে তোর ইতর ভাষায় কথা বলছি কী করে!
—হুম, অবাক
হয়েই প্রতাপ বলেছিল।
—মোদ্দা কথা
হল আগামী দুনিয়ার সব তেঢ্যামনাদের মোকাবিলায় ঈশ্বরের বরপুত্ররা পেরে উঠবে না, তাই
তোদের দরকার... শক্তপোক্ত প্রজন্ম তৈরি করতে। তারাই বাঁচাবে সভ্যতাকে।
—তা একা-একা
প্রজন্ম তৈরি করব কী করে... সে ব্যবস্থাটা করো দেখি... মিতালী ভেগে গেছে... তারপর
না হয় দিকে দিকে ছিটিয়ে বেড়াব।
—সে
বন্দোবস্ত হবে... তোর মতোই মাল জুটবে... ভাল মেয়েদের যুগ তো আর নেই... ঘর-বর সব
ছেড়ে তোর সাথে পথে নামবে, এর’ম মেয়ে জুটে যাবে ঠিক সময়ে...
তারপর আর
কিছু মনে নেই ওর। বন্ধুরা বালিতে ওকে পড়ে থাকতে আবিষ্কার করে। ততক্ষণে জল এগিয়ে
এসেছে খানিকটা। সবাই বুঝল আগের রাতের
নেশার জন্যই এই কাণ্ড। প্রতাপও কারও ভুল ভাঙাতে গেল না। তবে দেখল আশপাশে কিছু নেই। ডানাওলা তার ম্যাসেজ দিয়ে ফিরে গেছে নিজের জায়গায়।
এরপর থেকে
প্রতাপ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল— সবকিছু সেই অজ্ঞাত হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে চলে। তার জীবনও সেভাবেই চলছে। তবে প্রতাপ বুঝতে
পারছিল তার সঙ্গে কোনও একটা কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। আরও কারও জীবনে হয়তো এর’ম কিছু হয়েছে কিন্তু
সেটা জানার উপায় নেই। তবে ওর মনে হয় প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট হয়ে আছে। আগামী প্রজন্মের রূপরেখা তাদের দ্বারাই যে হবে
সেটা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। তবে মাঝেমধ্যে পরস্পরবিরোধী কিছু সিগন্যালও আসত। কিন্তু সেসব ফেন্ট সিগন্যাল। প্রতাপের মনে হত সব জায়গাতেই সরকার আর বিরোধী
দুই পক্ষ আছে। তবে ও সেই অনুযায়ী কিছু করত না বরং আগামীর ঘটনাগুলোকে দেখে আগের শোনা
কথাগুলো জাস্টিফাই করতে পারত। ক্রমশ এসব ফিসফাস শুনে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ব্যাপার প্রতাপ আগাম বুঝতে পারত। স্বাভাবিকভাবেই এতে তার ভেতরে একটা শ্লাঘা তৈরি
হত। তাই অন্যদের থেকে
নিজেকে আলাদা কিছু ভাবত প্রতাপ।
৩.
প্রতাপ ছোট থেকেই দেখেছে— যেটা
হতে চেয়েছে সেটা হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলায় সাঁতার শিখতে গিয়ে পেটে জল ঢুকে এমন আমাশা হল— সাঁতার বন্ধ। ফুটবল
খেলতে গিয়ে লিগামেন্ট ছিঁড়ে তাও বন্ধ। আঁকায় আর উৎসাহ পেল না কিছুদিন পর। নাচ-গান
চেষ্টা না করলেও পাড়ার নাটকের দলে ঢুকেছিল, দু’-চারটে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর সেই
দলটাও উঠে গেল। চেনাজানা বন্ধুর
সূত্রে শখের শর্টফিল্মে অভিনয় করেছিল কিন্তু কেন যেন সেই শুটিঙয়ের মেমোরি কার্ড
করাপ্ট হয়ে গেল। মোদ্দা কথা কিছুতেই
কিছু হল না। ক’বছর স্কুল-কলেজে
রিক্রুটমেন্ট বন্ধ, শেষমেশ প্রতাপ হয়ে গেল ক্লার্ক। যেটার বাংলা শুনলে
বিশ্বসংসারের লোক জেনেটিক্যালি নাক সিঁটকে আসছে।
ওর স্কুল-কলেজ
জীবনের বন্ধুরা বেশিরভাগ প্রাইভেটে কাজ করে, তাদের জীবনের ছবি অনেক চকচকে। বিডিও অফিসে গ্রুপ সি-তে যাই মাইনে প্রতাপ পাক,
প্রোফাইলটা তুলনায় যেন একটু ময়লা। রোজ জুতো পালিশ বা জামা ইন করে যাওয়ার প্রয়োজন
হয় না। যাদের সঙ্গে ডিল
করতে হয় তাদের অনেকেই লুঙ্গি-হাওয়াই চটিতে অভ্যস্ত। যদিও প্রতাপ জেনেছিল এদের
অনেকের কলকাতায় ফ্ল্যাট বা বড়সড় গাড়ি কেনার মতো টাকা আছে।
দু-একদিনের
মধ্যে বাসের সেই লোকটার সঙ্গে অফিসেই দেখা। প্রতাপ বুঝতে পারল ওর অনুমান ভুল ছিল না— কোল্ডস্টোরেজ
জমিজিরেত নিয়ে লোকটাকে এখানে বেশ প্রতিপত্তিশালী বলাই যায়। তার সাথে লোকাল পার্টির পাণ্ডা। তবে সে বেশ
সহৃদয় ভাবেই প্রতাপকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করে গেল। লোকটা চলে যেতে প্রতাপ ভাবছিল,
এই লোক কলকাতা থেকে একশো আঠারো টাকার নন এসি বাসে যাতায়াত করে! বিষয়টা স্বাভাবিক
না হলেও আশ্চর্যের যে নয় সে তো দেখাই যাচ্ছে।
সন্ধের পর
বিশেষ কিছু করার থাকে না বলেই হয়তো দু’-একদিন বাদে প্রতাপ ওদের বাড়ি উপস্থিত হল।
মেয়েটার নাম রাই কল্পিত হলেও লোকটার নাম সেদিন জানতে পেরেছিল— অসীম। অসীম সাধুখাঁ। ঘোষপাড়ায় এই বাড়িটাই আড়েবহরে সবচেয়ে বড়। সুতরাং
খুঁজে পাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। ঘরে ঢুকে দেখল মোটামুটি সাজানো, তবে আহামরি কিছু নয়। অসীম বেশ খাতির করে ওকে ঘরে বসালেও খানিকটা
আশ্চর্য লাগল রাইয়ের ব্যবহার। কারণ সে যেন বেশিরকম স্বাভাবিক। ‘ওকে সে কি তবে অপছন্দ করছে?’ প্রতাপের একবার মনে হল কথাটা। কিন্তু টুকটাক কথাবার্তাতে আবার তেমনও মনে হয়
না। তবে কি ও নিশ্চিত ছিল, প্রতাপ আসবে? ঠিক বুঝতে পারল না। অসীমকে মনে হল সেই
ধরনের লোক, যাদের টাকাপয়সা থাকলেও ঠিক তেমনভাবে শহুরে সমাজে মেশার সুযোগ পায়নি ফলে
চালচলনের ক্ষেত্রে অনেকটাই বউয়ের পরামর্শে চলে। দু’-একবার বেরিয়েও পড়ল সে কথা।
প্রতাপকে তার বউয়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শোনাতেও ব্যগ্র হয়ে পড়ল। বউটি ইচ্ছে করেই
কিনা কে জানে ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মনরে আমার’ গাইল। প্রতাপ গান খুব একটা না বুঝলেও এটা ধরতে পারল
মেয়েটা একেবারে আনকোরা নয়। তারপর প্রচুর খাওয়াদাওয়া হল। অসীমের আবদারে সন্ধেতে এত খাওয়া হয়ে গেল সেদিন, রাতে মেসে আর খেতে হল না
প্রতাপকে। সেটা অবশ্য খুব সুখের ব্যাপার।
রাতে ভাল
করে ঘুমও হল না তার। সে শুয়ে ভাবতে লাগল, বাসে সামান্য পরিচয়সূত্রে কারও বাড়ি যাওয়ার মতো আলাপী সে
তো কখনও ছিল না। তবে এই মেসের বিস্বাদ জীবনের কারণেই কি তার এই পরিবর্তন? নাকি ওই
মেয়েটা মানে যার বর মাঝেমাঝে আদুরে গলায় ‘ঝুমা’ বলে ডাকছিল সে যাবতীয় নিয়মের বাইরে
গিয়ে ওকে টেনেছে! তবে রাই নামটা একেবারে বৃথা যায়নি— প্রতাপ জেনেছে ওর ভাল নাম
শ্রীমতী ।
৪.
প্রতাপদের কলেজে একজন টিচার
ছিলেন যিনি জীবজগতের বিবর্তনকে কৃষ্ণের দশাবতারের সঙ্গে তুলনা করতেন। কী আশ্চর্য, সেটা মোটামুটি মিলেও যাচ্ছে দেখে
প্রতাপের মনে হত— এ নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার নয়। সবটা আদৌ কল্পনা নয়। এমন কিছু যোগসূত্র বা সংকেত আছে তা সাধারণ
মানুষের মেধায় বোঝা সম্ভব নয়। পুরোটাই হয়তো পরিকল্পিত কোনও বিষয়।
মানুষের
বিবর্তনে যেমন মিসিং লিঙ্কের ভূমিকা অপরিসীম, প্রতাপের মনে হত জেনেটিক
স্ট্রাকচারেও মাঝেমাঝে সের’ম বিরাট কিছু চেঞ্জ ঘটে গেছে। আপাতভাবে দেখলে মনে হয়
সেটা ঘটেছে অতর্কিতে। কিভাবে কেউ বুঝতে পারে না। যেন একটা স্পার্ক। প্রতাপের মনে হত এলিয়েনরা বোধহয় তাদের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু ব্যাপার
মাঝেমধ্যে মানবজাতিকে দান করে গেছে। তাই বোধহয় ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যাপারটা মানুষ
আদিকাল থেকে বিশ্বাস করে আসছে। যারা সেসব জিনের উত্তরাধিকার বহন করছে তারাই হয়ে
উঠেছে সভ্যতার নির্ণায়ক। এর’ম মানুষরা যুগান্তকারী এবং সৃষ্টিশীল কিছু ঘটনা
ঘটিয়েছে বলেই আজকের পৃথিবীর চেহারা এমন হয়েছে। বিষয়গুলোকে আশ্চর্যের মনে হয় কারণ
কিছুই ইউনিফর্মলি ঘটেনি, হঠাৎ ঘটে গেছে। মনে হয় যেন অদ্ভুত কোনও এক বিজ্ঞানীর
গবেষণায় হঠাৎ পাওয়া সাফল্য। যেটা মানুষকে একটা পর্যায়ের পর আর জানতে দেওয়া হচ্ছে
না।
সেই আশ্চর্য
ঘটনাটার কথা প্রতাপের মাঝেমাঝে মনে পড়ত। তারপর থেকে সভ্যতা সম্পর্কে নানারকম ধারণা তৈরি হয়েছে
প্রতাপের। একদিনে ও এসব বোঝেনি, ক্রমশ বিভিন্ন সিগন্যাল পেতে পেতে ওর বোধবুদ্ধি
খানিকটা সংগঠিত হয়েছে। প্রতাপ বুঝতে পেরেছে পৌরাণিক শ্রীকৃষ্ণ এলিয়েনদের মধ্যে
সবথেকে সফল ছিল। সেই ধাঁচেই আগামী প্রজন্মকে ঢালতে চাইছে হেড কোয়ার্টার। একইসঙ্গে কূট ও প্রেমিক, বন্ধু, কুশলী এবং
সর্বোপরি বস্তাপচা স্থিতিশীলতাকে নড়িয়ে দেওয়ার হিম্মত রাখে। পরবর্তীতে বহু
কালোত্তীর্ণ পুরুষ এসেছে কিন্তু তাদের ঔদার্যের যতটা নমুনা দেখা গেছে সেই তুলনায়
বাস্তববুদ্ধির যেন খানিকটা খামতি থেকে গেছে। তাই হেড কোয়ার্টারের মনে হচ্ছে এইসব
অতুলনীয় মানুষ এই দু’ নম্বরির দুনিয়ায় ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। সেটাই আসল সমস্যার
ব্যাপার। কারণ দুনিয়ার ক্ষমতাধারীরা সৃষ্টিশীলতার তোয়াক্কা করে না। তারা
যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকে। ফলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যারা
তাদের খানিকটা সেফ গার্ড দেওয়ার জন্য নতুন পরিকল্পনা। সভ্যতার জেনেটিক গতিতে যুক্ত
করা প্রয়োজন প্রতাপের মতো লাথখোর মালের জিন। যাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না।
সব জায়গা
থেকে হেরে যেতে যেতে যাদের একরোখা মনোভাব ছাড়া দেবার কিছু নেই। সুবিধে হল— এরা
দুর্জনের সঙ্গে বাঁকা পথে লড়তে থমকাবে না। তাদের সঙ্গিনীদেরও হতে হবে একইরকম
পর্যায়ের— যাদের কাছে সাধারণ কোনও সেন্টিমেন্টের গুরুত্ব থাকবে না। লক্ষ্মীমন্ত না
হয়ে বরং স্বৈরিণীদের প্রয়োজন বেশি করে। এতদিন মানবসভ্যতায় এদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া
না হলেও আগামীতে এইসব মানুষরাই হয়ে উঠবে কি ফ্যাক্টর।
প্রতাপের
মনে হয় তার জীবনে যা কিছু ঘটছে সবই এই উদ্দেশ্য পালনের জন্যই। তার কিছু না হওয়া
এবং শ্রীমতীর জীবনের নানারকম বিচ্যুতি এই পরিকল্পিত ঘটনার অংশ। তাই দু’জনেই দেখা
হওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা যোগসূত্র। আগে বহু পুরুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পর দুর্নাম লুকিয়ে অসীমের মতো
আধবুড়ো কিন্তু প্রতিষ্ঠিত লোককে বিয়ে করেছে শ্রীমতী। এখন এই গণ্ডগ্রামে ধু-ধু করা
মনে প্রতাপ এসে যাওয়াতে সে বেশ খুশি। শ্রীমতী যেন অপেক্ষায় ছিল। তাই সহজেই ওদের যোগাযোগ হতে শুরু করে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে।
আড়ালে আবডালে দেখাসাক্ষাৎ চলতে থাকে। ক্রমশ পরিকল্পনা জমে
উঠতে থাকে— সামাজিক বেড়া ভেঙে ফেলার জন্য। অসীম আন্দাজ যে করেনি তা নয়। তবে সে এই সময়টা খুব ব্যস্ত। নির্বাচনে সে এ অঞ্চলের প্রধাণ মুরুব্বি। দলের জন্য সে ঘরের দিকে সময় দিতে পারে না। ফলে
অবাধে প্রতাপ আর শ্রীমতী মেতে ওঠে জেনেটিক সংযোগের কাজে।
৫.
কাজকর্মে ওর বিশেষ উৎসাহ নেই
আজকাল। উদাস হয়ে বসে মাঝেমাঝে প্রতাপ ভাবে ওর বুকে কি এত দম আছে— রাধাকে বাঁশির
সুরে ডাকতে পারবে। পারবে কি এই অসীমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে? মালটা লোকাল চেঙ্গিস
খাঁ... তাকে কোন উপায়ে যে হারানো যাবে, কে জানে! এও তো একপ্রকার যুদ্ধ— ঘোড়ার পিঠে
চেপে শত্রুসৈন্যের ভেতর থেকে উদ্ধার করে আনা প্রেয়সিকে, ইউটিউবে প্রাচীন যুদ্ধের
সিনেমাতে যেমন দেখেছে। প্রতাপের খুব পছন্দ ছিল ইউটিউবে প্রাচীন যুদ্ধের ভিডিয়ো
দেখা। সব যে বুঝত তা নয়,
তবে এটা জানত যুদ্ধের সময় যে সেনাপতি কোনও অদ্ভুত মুভ করে যুদ্ধ জেতায় ইতিহাস তাকে
মনে রাখে। সৈন্যসংখ্যা সব সময়
বড় কথা নয়, আসল ব্যাপার হল ট্যাক্টিক্যাল মুভ। এসব ভাবনা বড় সংক্রামক। শরীর ও মনে প্রবল উত্তেজনা তৈরি করে। সেই উত্তেজনার আঁচ গিয়ে লাগে শ্রীমতীর শরীরে,
সেও উত্তেজিত হয়।
প্রতাপ বুঝতে পারে যতটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে। ইতিমধ্যে
কলকাতায় বদলি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশাও আছে কিন্তু এই ভোটটা এসে যাওয়ায়
কিছুই হচ্ছে না। এই গ্রামের ভোট
নিয়ে মারামারি-পুলিশ-আদালত-বিরোধী দল সব নিয়ে নানারকম খবর। নিত্য কেলাকেলি ওদের
অফিসের বাইরে। একদল নমিনেশান দেবে
আর-একদল আটকাবে। পুলিশ চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকে। এই করতে করতে এগিয়ে
আসে দিন। পাশের বুথে ডিউটি পড়ে ওর। সেখানে অসীমই মূল প্রার্থী। কিন্তু উলটোদিকে
একটা তিলে খচ্চর দাঁড়িয়েছে। নাম পটেন পাল।
পটেন ওর
কাছে এসেছে ভোটের আগের দিন। কালো দাঁত বের করে বলে গেছে, তুমি বেশি মাজাকি মারবে
না... অসীমের বউটাকে লুটছ কিছু বলিনি... কিন্তু কাল চুপচাপ থাকবে।
প্রতাপ অবাক হয়ে বলেছে, অসীম কিছু করবে না? হাত গুটিয়ে বসে
থাকবে?
পটেন চোখ
টিপে বলেছে, মালটাকে ঝেড়ে দেব রাতেই... খবর আছে আজ রাতে বাইকে একা ফিরবে। দেখি শালাকে কে বাঁচায়... তারপর হেসে বলেছে,
তোমার তো সুবিধেই হবে...
সেটা ঠিক।
মাথার ভেতর কে যেন বলে, এই সুযোগ। প্রতাপ প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। পরের দিন শ্রীমতিকে নিয়ে পালানোর। কিন্তু সেদিন রাতে অসীম বিষয়টা আঁচ করেই বোধহয়
পালটা প্ল্যান করে রাখে। ফলে তার কিছু হয়নি। বরং পটেনের অপচেষ্টা চাউর হয়ে যায়। ভোটের গতি দেখে প্রতাপ
বুঝতে পারে অসীমই জিতবে। তাই পরিকল্পনা বদলে ফেলে প্রতাপ। বাইরে ফুঁসতে থাকা পটেনের লোকদের সক্রিয়
সাহায্য করে। পরিচিতির সূত্রে অসীম বোধহয় ওকে সন্দেহ করেনি। অরক্ষিত অসীমকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে তুলে
দেয় ওদের হাতে। অসীম প্রাণে না মরলেও জখম হয়। সে সুযোগে শ্রীমতীকে সঙ্গে নিয়ে
পালায় প্রতাপ।
এমন পাগলপারা অবস্থার কোনও আন্দাজ ছিল না প্রতাপের। এবার কি
যে ঘটেছে, ভালো বুঝতে পারে না প্রতাপ। মনে হয় পুরনো ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিটা জেগে
গেছে। নিজেকে নিয়ে বড় দুর্ভাবনায় পড়েছে ও। মাঝেমাঝে মনে হয়, সেইসব দেবদূত ছিল আসলে ওর অতিরিক্ত মাল
টানার ফল। এর’ম সত্যি কিছু হতে পারে না।
মাঝেমাঝে মনে হয় হেডকোয়ার্টারের ক্ষমতা বোধহয় ঢ্যামনারা দখল
করেছিল, তারা নিজেদের ধাঁচে দুনিয়াটাকে চালাতে চেয়েছিল। বোধহয় সেই সাময়িক খারাপ সময়টা কেটে গেছে। তাই ইদানীং প্রতাপ যেসব সিগন্যাল পাচ্ছে তাতে
তার অপরাধবোধ প্রবল হচ্ছে ক্রমে। আবার পুরনো ধাঁচে শুভ্র সুন্দর শাশ্বতের বন্দনা
করার সংকেত আসছে। কিন্তু সেটার জন্য প্রতাপ কি উপযুক্ত! শ্রীমতী শুনে হাসে, আবার
ভয়ও পায় রাতে ঘুমের ঘোরে। শুনেছে অসীম আসছে ভোটে এমএলএ হবার টিকিট পাবে। প্রতাপ
সিগন্যালগুলো মাথার ভেতর খোঁজে, যেখানে ক্ষমতাশালীর হাত থেকে বাঁচার মন্ত্র থাকবে।
শ্রীমতীর
অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। যথানিয়মে সে বেশ বড়সড় একটা ছেলের জন্ম দিয়েছে। জল-হাওয়া-সেরেল্যাকে বাড়তে থাকা ছেলের দিকে
চেয়ে মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রতাপ। ভাবে তার কেরানি জন্মের গ্লানি আর ঘুচল না। এখন দেখা যাক ছেলেটা যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার
কিছু একটা হতে পারে।
No comments:
Post a Comment