বাক্‌ ১৪৪ ।। একটি স্বাভাবিক মৃত্যু । ধারাবাহিক উপন্যাস।। রাহুল দাশগুপ্ত

 

প্রথম পরিচ্ছেদ : রবিবার

Man does not learn unless he is thrashed.

Menander

 

একটা কাঁচের ঠান্ডা ঘর। তার ভেতর দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে বসে আছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। পারতপক্ষে কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। যদি বা তাকাচ্ছে, তাও আড়চোখে। যেন সবাই সবাইকে মেপে নিচ্ছে। আবার সবাই সবাইকে এড়িয়ে যেতেও চাইছে। নিজেদের লুকিয়ে রাখতে চাইছে, যাতে তাকে কেউ মাপতে না পারে। এরা কেউ যেন মানুষ নয়। কেউ কারো বন্ধু নয়। সবাই শুধু প্রতিযোগী। প্রতিদ্বন্দ্বী। এদের একে অপরের কাছে অন্য কোনও পরিচয় নেই। এদের ভেতর বসে খুব অস্বস্তি লাগছিল চেরাবের।

ঠিক সেই সময় লোকটিকে দেখা গেল। ক্ষিপ্র পায়ে এই ঘরটার দিকে হেঁটে আসছিল সে। মাঝারি হাইট, অসম্ভব মোটা, কুচকুচে কালো গায়ের রং, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামায় কালো রংটা যেন আরও তীব্র হয়ে চোখে লাগছে। লোকটিকে দেখে খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। যেন কোনও দয়া-মায়া নেই। মানবিকতা নেই। কেমন যেন ঘেন্নাও হয়। সবাই হঠাৎ ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

ঘরে ঢুকে লোকটি মোলায়েম গলায় কিন্তু কর্তৃত্বের সুরে বলে, আপনাদের সবার কাছে চিঠি আছে তো?

সবাই মাথা নাড়ে।

চেরাব হঠাৎ আবার সেই দুর্গন্ধটা পায়। গোটা ঘরটা যেন দুর্গন্ধে ভরে গেছে। বাতাস আবার ভারি হয়ে উঠেছে। সে পকেট থেকে রুমাল বার করতে যায়। পারে না। লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সন্দেহ আর বিদ্বেষ মিশে আছে তার চোখে। কুতকুতে দু-টো চোখের কোটর থেকে ধূর্ত আর শাণিত সেই দৃষ্টি বেরিয়ে আসছে। নির্দয়ও বটে। চেরাব চোখ নামিয়ে নেয়। দুর্গন্ধের উৎস সে ধরতে পেরেছে। এই লোকটিই সেই উৎস।

লোকটি বলে, আমি আপনাদের একজন একজন করে ডেকে নিয়ে যাব। তারপর আঙুল দিয়ে প্রথমেই দেখায় একটি মেয়েকে। মেয়েটি সুন্দরী। এতক্ষণ যেন ধ্যান করছিল। হঠাৎ চকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। লোকটিকে অনুসরণ করে। আর তখনই চমকে ওঠে চেরাব। লোকটি শুধু নির্দোষ নয়, নির্লজ্জও বটে। তার সাদা পায়জামাটা অতি পাতলা কাপড়ের। ভেতরে কোনও অন্তর্বাসও নেই। সেই পাতলা আবরণ ভেদ করে তার কুচকুচে কালো পেছনটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেয়েটিকে নিয়ে লোকটি অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ওই কাঁচের ঘরটার বাইরে গোটা অফিসটাই কেমন যেন ছায়া ছায়া অন্ধকারে ঢাকা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চেরাব।

হঠাৎ পাশ থেকে একটি ছেলে ফিসফিস করে ওঠে, এখানে ডাক পাওয়া খুব কঠিন।

চেরাব আবার চমকে ওঠে। তারপর বলে, কেন?

বলেন কী! খুব নামডাক এই কোম্পানির। এখানে চান্স পাওয়া অত সোজা নয়। আপনি কবে অ্যাপ্লাই করেছিলেন?

চেরাব বিপদে পড়ে। বলে, আপনি?

তা বছর দুয়েক আগে তো বটেই! ছেলেটি যেন ঘোরের মধ্যে বলে যায়, আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি যে, ডাক পাব। হঠাৎ এই চিঠি...

ছেলেটির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তারপর বলে, প্রচুর হোমওয়ার্ক করেছি। এখন দেখা যাক, কী হয়...

চেরাব চুপ করে শোনে। তারপর বলে, আপনার আত্মবিশ্বাস দেখে ভালো লাগছে...

ছেলেটি তেজি গলায় বলে, হ্যাঁ, আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী...

চেরাব হঠাৎ জানতে চায়, আপনি কি একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছেন?

ছেলেটি ঘাবড়ে যায় হঠাৎ। তারপর বলে, দুর্গন্ধ! কই না তো? এখানে দুর্গন্ধ আসবে কোত্থেকে?

আসলে, আমার নাকটা খুব সেনসিটিভ। আমি এমন সব গন্ধ পাই...

হঠাৎ সেই কদর্য লোকটি আবার ফিরে আসে। সঙ্গে মেয়েটি। পাশের ছেলেটির দিকে আঙুল দেখিয়ে তাকে অনুসরণ করতে বলে। মেয়েটি ধপ্ করে চেরাবের পাশেই বসে পড়ে। ছেলেটি বীরদর্পে লোকটিকে অনুসরণ করে। যুদ্ধ সে আগেই জিতে গেছে। এখন শুধু ঘোষণার অপেক্ষা।

মেয়েটি কেমন একটু ঘাবড়ে আছে। সবাই ওকে ঘিরে ধরেছে। অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহল তাদের। সেগুলো সব তিরের মতো ছুটে আসছে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির গায়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে।

মেয়েটি আড়চোখে চেরাবের দিকে তাকায়। খুব শান্ত হয়ে বসে আছে সে। যেন বা ব্যাপার-স্যাপার দেখে একটু মজাই পাচ্ছে। কোনও চাপও অনুভব করছে না। হ্যাঁ, একমাত্র তাকে দেখেই মনে হচ্ছে, কোনও চাপ ও উদ্বেগ নেই। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই সে বসে আছে। মেয়েটির খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।

চেরাব হঠাৎ অস্পষ্ট বেহালার সুর শুনতে পায়। বহুদূর থেকে যেন ভেসে আসছে সেই সুর। মেয়েটি যখন তার দিকে তাকাচ্ছে, তখন সেই সুর যেন আরো তীব্র হয়ে উঠছে। এইসব উদ্ভট ব্যাপার তার সঙ্গেই শুধু ঘটে। নিজের ওপরেই একটু বিরক্ত হয়ে ওঠে সে।

 

লোকটিকে অনুসরণ করছিল চেরাব। বাঁ পাশে সারি সারি কাঁচের ঘর। সেইসব ঘরের ভেতর আবছা, তরল অন্ধকার। একটা সরু করিডর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। মাথার ওপর টিমটিম করে জ্বলছে আলো। তাকে কোথায় নিয়ে চলেছে লোকটি? এখানে কোনও আনন্দ নেই। কেমন একটা দমচাপা ভাব। এখন ওর ক্যাম্পাসে থাকার সময়। অথবা ইউনিভার্সিটির খোলা মাঠে। সেখানে কত আনন্দ! সেই আনন্দকে ছেড়ে এখানে কেন এসেছে সে? চেরাব আর ভাবতে পারে না! একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা।

এটা একটা স্বয়ংক্রিয় দরজা। ওরা সামনে এসে দাঁড়াতেই খুলে যায়। প্রথমে লোকটি ঢোকে। তারপর ঢোকে চেরাব। বেশ বড়ো ছিমছাম একটি কাঁচের ঘর। ভেতরে আলোয় ঝলমল করছে। সামনে একটা বিরাট টেবিল। তার পিছনে মস্ত গদিওয়ালা চেয়ারে একজন বৃদ্ধ লোক বসে। ঢোকার সময় বাইরে থেকে লোকটিকে দেখা যায়নি। কিন্তু চেয়ারটিকে দেখা গেছে। কুচকুচে কালো রং চেয়ারটির। এবং বাইরে থেকে সবসময়ই দেখা যায়। লোকটির হাতে একটা রিমোট। বোঝা যায়, ওই রিমোটের বোতাম টিপেই লোকটি এই ঘরে প্রবেশ ও প্রস্থান নিয়ন্ত্রণ করে।

এই তাহলে বস! অত্যন্ত সুদর্শন চেহারা বসের। অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। টকটকে ফরসা গায়ের রং। শুধু চোখ দুটো যেন ঠিক বোঝা যায় না। কোটের ভিতর সেঁধিয়ে আছে সেগুলি। তাই বলে বুঁজে নেই। অসম্ভব সেই তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। চামড়ার ভাঁজের মধ্যে চোখ দুটো দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টির আঁচ ঠিকই টের পাওয়া যায়। ঢোকার পর থেকেই লোকটি ওকে মেপে চলেছে। কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না কিছুই।

এই লোকটি অফিসের সর্বেসর্বা। ইনিই তবে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছেন? কোনও অ্যাপ্লিকেশনই সে করেনি। এই চাকরির ব্যাপারে কিছুই জানে না সে। অথচ চিঠি পাঠিয়ে ওকে ডেকে এনেছে! এটা যদি ঠাট্টা নয়, তবে ঠাট্টা কাকে বলে? কিন্তু কী চায় এরা? কেন তাকে ডেকে আনা হয়েছে এইভাবে?

চেরাব হাসি হাসি মুখে বসে থাকে। কোনও প্রত্যাশা নেই তার। কোনও হোমওয়ার্কও সে করেনি। এই চাকরির ব্যাপারে কিছুই সে জানে না। তার সঙ্গে ঠাট্টা করা হয়েছে। সে নিজেও এসেছে মজা দেখতে। একদিনের, অল্প একটু সময়ের মজা। তারপর আবার সে ফিরে যাবে নিজের স্বাভাবিক জীবনে।

বসের গলা অত্যন্ত গম্ভীর। তিনি বলে ওঠেন, আগে কোনওদিন চাকরি করেছো?

নাঃ! চেরাব মাথা নাড়ে। বসের মাথার পিছনে কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল, সবুজ সমুদ্র। সেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ফেনা। আর কী আশ্চর্য, সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সেই একলা কালো ঘোড়াটি। এদিকেই তাকিয়ে আছে সে। অথচ কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব!

সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার বসের দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় চেরাব। লোকটিকে দেখে ওর খুব কৌতূহল হচ্ছে। অদ্ভুত একটি লোক। কিন্তু চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। লোকটির মধ্যে কোথায় রয়েছে এই চুম্বক?  লোকটির ক্ষমতায়? কী বিপুল ক্ষমতা এই লোকটির? গোটা একটা অফিস তাঁর অঙ্গুলিহেলনে চলে! অথচ বাইরে থেকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। শুধু চোখ দু-টো দেখলে চমকে উঠতে হয়। যেন পাথরের একটা মূর্তি। তার ভেতরে দুটি তীক্ষ্ণ, ধারালো, জীবন্ত চোখ।

বস ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। এবার বলেন, কী ভাল লাগে তোমার?

আমার? চেরাব একটু ভাবে। তারপর বলে, লিখতে।

কী লেখ তুমি?

যা মনে আসে। যা লিখতে ইচ্ছা করে।

তোমার হাতের লেখা আমি দেখেছি। চমৎকার!

চেরাব এবার তাজ্জব বনে যায়। বস ওর হাতের লেখা দেখেছেন! কোথায়? কীভাবে? এ কী ভেলকিবাজি নাকি?

ও এদের নিয়ে কিছুই হোমওয়ার্ক করেনি। এরা কিন্তু ওকে নিয়ে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে রেখেছে!

বস বলেন, তুমি আজ থেকেই কাজে লেগে যাও। একটু পরেই সবাই এসে যাবেতোমাকে ওরা কাজ বুঝিয়ে দেবে।

সেই কদর্য লোকটি এবার মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। এতক্ষণ সে চোখ নামিয়ে নত মাথায় তীক্ষ্ণ চোখে মেঝের দিকেই তাকিয়ে ছিল। বসের ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা তাঁর অন্যান্য আঙুলের চেয়ে একটু বেশিই দীর্ঘ। তিনি সেই বুড়ো আঙুল দিয়ে লোকটার মাথায় একটা টোকা মারেন। লোকটি উঠে বসে।

চেরাব বোঝে, সে পাশ করে গেছে।

বস আবার বলেন, সাতদিন একটু মন দিয়ে কাজ করো। আমরা দেখে নেব। তারপর কনফারমেশন লেটার পেয়ে যাবে। তোমার স্যালারিও ওই চিঠিতেই লেখা থাকবে।

চেরাব কি স্বপ্ন দেখছে? কী কাজ করবে সে? কী কাজ হয় এখানে! সে তো এদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। তারা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করারই বা কী হবে? তার মনের সব আনন্দ নিভে যাচ্ছে। সব আলো নিভে যাচ্ছে। একটা চাকরি পেয়েছে সে। আর এই ঘটনা কী বিষণ্ণই না করে তুলেছে তাকে!

সে কী করবে এখন? বাড়ি ফিরে যাবে? কিন্তু সে তো হয় না। অনুরণন কী বলবে ওকে? কী জবাব দেবে সে তাকে? অনুরণন যদি বলে, চাকরিটা তুই পেয়েও ছেড়ে এলি? আর আমি...

 

আবার সেই পরিচিত কাঁচের ঘর। আত্মবিশ্বাসী ছেলেটি ওকে দেখেই এগিয়ে আসে। চেরাব একটু বিব্রত বোধ করে। ছেলেটি জানতে চায়, কেমন হল ভাই?

কী বলবে চেরাব! সে যেন একটা স্বপ্নের ভেতর ঢুকে গেছে। একটা নিষিদ্ধ স্বপ্ন। এই স্বপ্নের কথা কাউকে বলা যায় না। সে মৃদু হাসে। তারপর বলে, এই যেমন হয় আর কী...

ঠিকই বলেছো! যেমন হয়। আমাকে তো জিজ্ঞেস করল, আমি রাজনীতি করি কী না! সটান বলে দিলাম, করি! মিথ্যা কথা বলব কেন ভাই! যা করি, তা নিয়ে লুকোছাপা আমি করি না।

ছেলেটি ইতিমধ্যেই খুব ইনভলভড হয়ে গেছে। অনেক কিছু আশাও করছে। কেমন যেন মায়া হল চেরাবের। একটু করুণাও। কিন্তু তার ব্যাপারটা ক্রমেই যেন দুর্বোধ্য আর ব্যাখ্যাতীত হয়ে উঠছে। সে চোখ বুজে ফেলে। আর তখনই দেখতে পায় অনুরণনকে। ঠিক তার মুখোমুখি বসে আছে অনুরণন। একটা কাঠের চেয়ারে। মিটিমিটি হাসছে।

চেরাব জানতে চায়, এসব কী হচ্ছে অনুরণন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না...

অনুরণন কিছু বলে না। শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

অনুরণন! চেরাব আবার ডাকে। তারপর বলে, আমি কিন্তু কোনও অ্যাপ্লিকেশনই করিনি। কিছুই জানতাম না আমি। হঠাৎ ওই চিঠি। বসকে সেকথাই বলতে চেয়েছিলাম আমি। হয়তো ওদের কোথাও ভুল হচ্ছে। কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে আমাকে। কিন্তু ওরা আমাকে কিছু বলতেই দিল না। কিছু জিজ্ঞেসও করল না...

অনুরণন মিটিমিটি হাসতে থাকে।

তাছাড়া, চেরাব বলতে থাকে, আমি ঠাট্টা বলেই গোটা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বসের চোখ দেখেই বুঝতে পারলাম, ওদের কোথাও ভুল হয়নি। ওরা আমার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। ভুল অমারই হয়েছিল। আমিই চিঠির ব্যাপারটাকে লঘু করে দেখেছিলাম। ওদের বুঝতে পারিনি।

অনুরণন কোনও কথা বলে না। শুধু চেরাবের দিকে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।

চেরাব বলতে থাকে, কেন এমন হয় অনুরণন? তুমি চাকরি চেয়েছিলে। কেউ তোমাকে চাকরি দেয়নি। কত চেষ্টা করেছিলে তুমি! তোমার মতো উদ্যোগী মানুষ আমি কমই দেখেছি। এদিকে দেখো, আমি চাকরি চাইনি। আর ওরা আমাকে চাকরি দিল। কোনও চেষ্টাই করতে হল না আমাকে। এমনকি আমাকে কোনও পরীক্ষাই করা হল না! নিজেকে প্রমাণ করার কোনও সুযোগই দেওযা হল না আমাকে। নিজের থেকেও কিছু বলার সুযোগ পেলাম না আমি। আমাকে স্রেফ চাকরিটা দিয়ে দেওয়া হল। যেন আমাকে উপহার দেওয়া হল। এখন এই উপহার নিয়ে আমি কী করব অনুরণন? আমি তো এর জন্য প্রস্তুত নই। আমার তো প্রতি পদে ভুল হবে। তখন এরা আমাকে সহ্য করবে তো?

চোখ খুলল চেরাব। সেই আত্মবিশ্বাসী ছেলেটি তখনও ওর পাশে বসে অনর্গল বকে চলেছে। চেরাব আবার চোখ বুজল। আবার সে দেখতে পেল অনুরণকে। তখনও সে মিটিমিটি হাসছে।

চেরাব বলে চলল, তুমি চাকরি পাওনি বলে কত দুঃখ পেলে! এদিকে চাকরি পেয়েছি বলে আমার মনে কোনও আনন্দ নেই। এখন আমি ইউনিভার্সিটি যাব কী করে? ক্লাস করব কী করে? ওগুলোই তো আমার আনন্দের উৎস! বিশেষ করে, ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি! আমার ভেতরে সব আলো নিভে আসছে। অথচ আমি নিরুপায়! কেউ যেন হাত-পা বেঁধে আমাকে জলে ফেলে দিয়েছেএ আমার তুমি কী করলে অনুরণন? আমি তো এখন চাকরি চাইনি। আমার ঠাকুমা এখনও পেনশন পান। আমার মা-বাবা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার আগে আমার জন্য যথেষ্ট রেখে গেছেন। এখন আমার রোজগার না করলেও চলবে। এখন আমার আনন্দ করার সময়। কিন্তু তবু একটা চাকরি পেয়ে, যে চাকরি আমি চাইনি, আমি ছাড়তে পারছি না। চাকরি নিয়ে আমার মধ্যে নিরাপত্তার কী প্রচণ্ড অভাব! কী ভীষণ ভয় আর আতঙ্ক! কী বিপন্নতা আমার! তোমার মৃত্যু আমার সমস্ত আত্মবিশ্বাসকে ঝাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। চাকরি পেয়ে এখন আমি ছাড়ি কী করে? তুমি এ আমার কী করলে অনরণন?

 

কেউ বেহালা বাজাচ্ছে। তার মধুর সুর ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ঘরে। চেরাব চোখ মেলে তাকাল। সেই মেয়েটি তার পাশে বসে আছে। ঘরে আর কেউ নেই।

মেয়েটি চেরাবের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।

কেউ বেহালা বাজাচ্ছিল এখানে। তাই না? আপনি কী শুনতে পেয়েছেন?

মেয়েটি অবাক হয় খুব। তারপর বলে, না তো!

ঠিক বলছেন আপনি? আমি স্পষ্ট শুনলাম...

এটা একটা অফিস। তাই না? মেয়েটি মৃদু হাসল। তারপর বলল, আপনি খুব সেনসিটিভ। আর সেন্টিমেন্টাল।

আপনি বোধহয স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বেহালা বাজান নাকি?

উহুঁ। চেরাব বলে। তবে বেহালা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু বাকিরা সব গেল কোথায়?

চলে গেছে।

কেন?

কারণ, তেমনই বলা হয়েছে ওদের। শুধু আমাদের দু-জনকে থাকতে বলে গেছে। চাকরিটা বোধহয়...

সেই আত্মবিশ্বাসী ছেলেটির মুখ দেখতে পেল চেরাব। আর এক অনুরণন। এই আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত থাকলে হয়! হৃদয়পুর মানুষের আত্মবিশ্বাসকে ঠিক সহ্য করে না। পিষে মেরে দেয়। এই দ্বীপশহরটা খুব কৌতুকপ্রবণ। যুবক-যুবতির মন ভেঙে দিয়ে তাদের ভাঙাচোরা মন নিয়ে কৌতুক করতে ভালবাসে।

মেয়েটি হঠাৎ জানতে চায়, আপনি কী একজন স্টুডেন্ট?

ঠিক ধরেছেন। চেরাব বলল।

কোনটা ছাড়বেন? চাকরি না পড়াশুনো?

সাতদিন দেখি।

ঠিক বলেছেন। আমিও তাই। কিন্তু চাকরিটা আমাকে পেতেই হবে...

কেন?

আমার নিজের জন্য। বেঁচে থাকতে গেলে অনেক টাকা লাগে। আমার সেটা নেই।

আমারও নেই। তবে আমি চালিয়ে নিতে পারব। চাকরিটা কনফার্ম না হলেও আমার চলবে।

ওঃ!

কিন্তু আমি খুব লোভী হয়ে উঠছি। চাকরিটা খুব পেতে ইচ্ছা করছে...

চাকরি মানুষকে লোভী করে তোলে।

ঠিক বলেছেন। পড়াশুনোটা আমি ভালবাসি। ইউনিভার্সিটি, সেখানকার বন্ধুরা আর পরিবেশ, আমার খুব প্রিয়। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে...

মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে তাকায়।

চেরাব বলে যায়, চাকরিটা কনফার্ম হলে বেশ হয়। পকেটে টাকা থাকলে নিজেকে সম্রাটের মতো মনে হয়। আর না থাকলে, ভিখিরি। কত আর বাড়ি থেকে টাকাপয়সা চাওয়া যায়?

আমারও সেই কথা। একদম মনের কথা বলেছেন।

ঠিক সেই সময কাঁচের দরজা খুলে একজন লম্বা মতন লোক ঢোকে। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, এসো এদিকে।

চেরাব আবার সেই দুর্গন্ধটা পায়। কোত্থেকে আসছে এই দুর্গন্ধ?

 

                                                                                (ক্রমশঃ)

1 comment:

  1. খুব ভালো লাগল। ভীষণ আশাবাদী এই উপন্যাস নিয়ে।

    ReplyDelete