ঝুমুর
আজ সকাল থেকেই
বাসুদেবের মনটা ভালো। বহু-বহুদিন পর আজ তার একাকীত্ব কাটবে। এত বড় বাড়ি আজ তা
প্রায় কুড়ি বছর ধরে একা-একা সামলে আসছে। সেই কবে বাবার হাত ধরে প্রথম এই বাড়িতে
এসেছিল। এত বড় বাড়ি পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে বাগান দেখা, সবজি চাষ সব সে
নিজের হাতেই করে। সময় কেটে যায়। কিন্তু একা লাগে বড্ড। বড়সাহেব বেঁচে থাকতে মাঝেমাঝেই এখানে
আসতেন। তখন খুব ভালোলাগত। গিন্নিমা তো বহুদিন আগেই গত হয়েছেন। বড়সাহেব আরামকেদারায় ওই দোতলার
বারান্দায় বসে থাকতেন। সাহেব কখনও বাসুদেবকে চাকর ভাবতেন না। ছোট ভাইয়ের মতোই
ভালবাসতেন। বিকেলবেলায় ওই কেদারায় বসে চা খেতেন।
বাসুদেব পায়ের কাছে বসে থাকত। দুজন একসঙ্গে সূর্য ডোবা দেখত। সাহেব বলতেন, জানিস এই
বাড়িটা বড় সাধ করে কিনেছিলাম। তখন তোর গিন্নিমাকে সবে বিয়ে করে এনেছিলাম। কী
সুন্দর দেখতে ছিল তাকে! যেন সদ্য ফোটা পদ্মের মতো। নামটাও ছিল পদ্ম। কী হয়ে গেল! ছেলেটাকে
একা রেখে আমাকে একা করে দিয়ে কোথায় চলে গেল...
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।
বাসু ওই দেখ সূর্য কেমন ডুবছে! আমিও একদিন ঝুমুর নদীতে ডুবে যাব! সেদিনও
কিন্তু তুই এই বাড়িটার এভাবেই খেয়াল রাখিস। জানবি এই বাড়ির আনাচে-কানাচে তোর বড়সাহেব আর গিন্নিমা
আছেন। এ বাড়ি আমার স্বপ্ন।
বড়সাহেব এই বাড়িতেই মারা যান। তাঁর শেষ সময়ে যেন তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। আজও
বাসুদেব বাড়ির হাওয়ায় বড়সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মাঝেমাঝে ঝুমুর
নদীর দিকে তাকালে বাসুদেবের মনে হয় তাকে বড়সাহেব ‘বাসুউউউ...’ বলে ডাকছেন। এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাসুদেব মন দিয়ে করে যেমন আদেশ করে গিয়েছিলেন বড়সাহেব।
এখন এই বাড়ি শুধু বড়সাহেবের স্বপ্ন নয় বাসুদেবেরও প্রাণ।
বড়সাহেবের একমাত্র ছেলে অনিমেষ। বাসুদেবের ছোটসাহেব। ছোটসাহেব বড়সাহেবের
মতনই অত্যন্ত ভালো মানুষ। বাসুদেবকে সে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। তার স্ত্রী বাসুদেবের
নতুন গিন্নিমা খুবই ভালো মেয়ে। শিক্ষিতা। বাসুদেব শুনেছে সে নাকি চাকরিও করে।
তাদের একমাত্র মেয়ে তিতলি। বাসুদেব এসব শুনেছে ছোটসাহেবের মুখেই। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি। আজ বড়ই খুশির দিন। কারণ আজ ছোটসাহেব, গিন্নিমা আর তাদের ছোট্ট মেয়ে তিতলি এই বাড়িতে আসছে।
বাসুদেব সকাল থেকেই সব গোছগাছ করে পরিষ্কার করে রেখেছে। দোতলার বড়সাহেবের
ঘরের পাশের ঘরটা বেশ বড়। সেটাও দোতলার ব্যালকনির সঙ্গে যুক্ত। সরাসরি ঝুমুর নদী
দেখা যায়। ওই ঘরটা বাসুদেব ছোটসাহেবদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে। নিজস্ব বাগানের
ফুলে সাজিয়েছে প্রতিটা ফুলদানি। খাবারেরও যথেষ্ট আয়োজন। বাগানের টাটকা সবজি-ফল সব
গুছিয়ে রেখেছে। রাখাল নদীর মাছ দিয়ে গেছে। যে ক’দিন সাহেবরা থাকবেন ওপাড়ার
লক্ষী রান্না করে দিয়ে যাবে। আজ সকালেই সে চলে এসেছে। আয়োজন প্রায় করে ফেলেছে।
সকাল দশটার দিকে বাসুদেব নদীর ঘাটে গিয়ে বসে রইল। ছোটসাহেবদের এখনই আসার কথা।
ওই যে নৌকা আসছে। বাসুদেবের মন
উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। গলায় গামছা জড়িয়ে কাদার মধ্যে খানিক এগিয়ে যায়। রাগও হচ্ছে।
গত দু’-একদিন কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঘাটটাকে একেবারে কাদা-কাদা করে দিয়েছে।
ছোটসাহেব বিশেষত গিন্নিমা প্রথম আসছেন। কী যে কষ্ট পাবেন! ইশ্!
নৌকা পারে ঠেকল। ছোট সাহেব আগেই ‘বাসু কাকা এ কী অবস্থা!’ বলে হাঁক পেড়েছেন।
আর বলেন না ছোট সাহেব, হঠাৎ বৃষ্টি। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কাদা ছিটাচ্ছে। সাহেব বাক্সটা আমায় দিন। গিন্নিমা
মা লক্ষ্মীকে আমার কোলে দিন।
সাবধানে আসবে সঞ্চারী। সাবধানে এসো। পড়ে যেও না। হাত ধরো।
আরে না গো, এত আতুপুতু করো না তো। সব অভ্যাস করা ভালো।
বাসুদেবের সঞ্চারী নামটা বেশ পছন্দ হয়। কী মিষ্টি নাম। আর ব্যবহারটাও কত মিষ্টি।
মিষ্টি গলা। শিক্ষার একটা দাম তো থাকবেই। বাসুদেব মনে মনে বড়সাহেবকে ডাকল। বলল, বড়সাহেব আপনার রক্ত মিছে নয়, আমাদের ছোট গিন্নিমাও কিন্তু রূপে গুণে আমাদের বড়
গিন্নিমার ছায়া।
তিতলি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাসুদেব দেখল একরাশ কালো চুল। দুধে-আলতা গায়ের রং। মিষ্টি গন্ধ। ওর-ও একটা নাতনি ছিল। একমাত্র মেয়ের
ঘরের। বাসুদেব ওর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল নদীর ওপারের পূর্বপাড়ায়। বউ তো বহুদিন
আগেই গত। মেয়ে-জামাই খুব ভালোই ছিল। নাতনিটা এমনই ছিল। ছুটে ছুটে এসে কোলে উঠত। দু’দিনের জ্বরে মরে গেল। শোকে মেয়েটাও মরে গেল। জামাই কোথায় নিরুদ্দেশ হল কে
জানে। বাসুদেব গামছায় সবার অজান্তে চোখ মোছে।
বাসু কাকা এত সুন্দর বাগান তুমি কী করে করলে গো? কত সুন্দর সুন্দর ফল-ফুল-সবজি!
কী আর করব সারাদিন ছোটবাবু। বড়সাহেব চলে যাবার পর একলাপনা কামড়াতে আসে। তাই এইসব করে সময় কাটাই।
বাহ্ বাহ্। জানো বাবা বলত এই বাড়িটায় ওনার আত্মা থাকবে চিরকাল। মারাও গেলেন
এখানে।
ঠিকই বলেছেন ছোটবাবু। সাহেব আমাকে ওই একই কথা বলতেন। চলুন দেরি করবেন না।
গিন্নিমা আর মামনি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।
দোতলার বারান্দায় গিয়ে নতুন গিন্নিমা আপ্লুত হয়ে ওঠেন।
কী অপূর্ব! বাসুকাকা ওই নদীর নাম কী? নামটা জানা হল না তো!
ঝুমুর।
অপূর্ব!
সকালে দেখবেন চোখ জুড়িয়ে যায়। বড় সাহেব তো এখানেই বসে থাকতেন সারাদিন।
বলতে বলতেই তিতলির ঘুম ভেঙে যায়। তিতলি চোখ কচলাতে কচলাতে বুঝে পায় না ও কোথায় আর কার কোলে।
ঠোঁট ফোলাতে দেখেই বাসুদেব বলে ওঠে, মা লক্ষ্মী কাঁদে না সোনা। আমি তোমার বাসুদাদু।
টিয়া পাখি দেখবে? এই দেখো...
বাসুদেব দোতলার বারান্দায় রাখা টিয়াপাখির খাঁচার দিকে এগিয়ে যায়। ছোট্ট
তিতলির কান্না নিমেষে উধাও হয়ে যায়। সে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
সঞ্চারীকে বেশ ভালোলাগে বাসুদেবের। সন্ধ্যাবেলায় চা দিতে গিয়ে দেখে সঞ্চারী
চেয়ারে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে গান করছে, ওগো নদী আপন বেগে পাগল-পারা...
বাসুদেব কোনও আওয়াজ না করে চা-টা রেখে মেঝেতে বসে গান শুনতে থাকে।
আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে...
কী সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর! গোধূলির এই রাঙা আলোতে খোলা চুলে সঞ্চারীকে যেন স্বর্গের
দেবী মনে হচ্ছে। বাসুদেব অজান্তেই কপালে প্রণাম ঠোকে। তিতলি টিয়াপাখির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে খেলছে। তিতলিকে দেখে বাসুদেবের মন
খারাপ হয়ে যায়। এত সুন্দর একটা নিষ্পাপ শিশু। কিন্তু তিতলি কথা বলতে পারে না। বোবা। ডুবন্ত সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে মনে মনে বলে, এত সুন্দর বাচ্চাটার
মুখের ভাষা দাও ঠাকুর। মায়ের এত সুন্দর গলা থেকে বঞ্চিত করো না বাচ্চাটাকে।
এ কী বাসু কাকা তুমি নিচে বসে কেন?
কিছু না নতুন গিন্নিমা। গান শুনছিলাম। এমন সুন্দর গলা প্রাণ জুড়িয়ে গেল যেন।
তিতলি ছুটে এসে বাসুদেবের কোলে চড়ে বসে।
গল্প শুনবে? রাজকন্যার গল্প?
তিতলি আনন্দে হাততালি দেয়।
ভোরে বাসুদেবের ঘুম ভাঙে সঞ্চারীর মিষ্টি স্বরে।
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল...
উঠে এসে দেখল সঞ্চারী বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গান গাইছে।
আপনি এত ভোরে?
আমার খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস। বাবা ছিলেন দারোগা। ছোটবেলা থেকে খুব কড়া শাসনে
মানুষ আমি।
আপনি উপরে যান আমি চা পাঠাচ্ছি।
না না, ব্যস্ত হোয়ো না। একটু পরে খাব, বলে সঞ্চারী চলে যায়। তিতলি ছুটতে
ছুটতে আসে আর হাত দিয়ে একটা প্রজাপতি দেখাতে থাকে। সারা বাগান ছুটে বেড়ায়
প্রজাপতির পিছন পিছন। বাসুদেবও বাচ্চা হয়ে যায়। সে-ও ছুটতে থাকে তিতলির পিছন
পিছন।
তিতলিকে ফুল দিয়ে গলার হার বানিয়ে দেয়। তিতলিকে কোলে করে নিয়ে যায় ঝুমুর
নদী দেখাতে। ঘুরে ঘুরে আম, জাম,
বট, নারকেলের বাগান দেখায় তিতলিকে। ছোট শহুরে বড় বড় চোখ করে দেখতে থাকে সবকিছু।
গোছা গোছা কোঁকড়া চুলের গোছা কপাল বেয়ে নেমে এসেছে মুখের সামনে। বাসুদেব চুলটাকে
সরিয়ে দেয়। তিতলি চোখ চুলকায় হাত মুঠো করে। বাসুদেবের প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। দু’
চোখ বেয়ে নেমে আসে অঝোর ধারা। তিতলির পা দুটো নিজের মাথায় ঠেকিয়ে অঝোর নয়নে
কাঁদতে থাকে। ছোট্ট তিতলি অবাক
চোখে চেয়ে থাকে তারপর বাসুদেবের গামছার খোটা দিয়ে বাসুদেবের চোখ মুছিয়ে দেয়।
মাত্র কয়েকদিনেই বাসুদেবের সারা জীবনময় হয়ে ওঠে তিতলি। তিতলিকে গল্প শোনানো, ওর নিঃশব্দ বায়না মেটানোই যেন বাসুদেবের বেঁচে থাকার
একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতদিনে বাসুদেবের মনে হয় এত জন্মের তার একাকিত্বের
সাধনার ফল তিতলি। ওর হারিয়ে যাওয়া সবকিছুর প্রতিদান তিতলি। নতুন গিন্নিমার ভোরের আরোহণ আর তিতলির নিঃশব্দ চঞ্চলতা এই দুই ঘিরেই বৃদ্ধ
বাসুদেবের জীবন হাজারো পাখির কুহুতানে ভরে ওঠে। ছোটসাহেব তার হারানো বড় সাহেব।
জীবনে আর কিছু পেতে বাকি থাকে না বাসুদেবের। বাড়িটা যেন তার জীবন ফিরে পায়।
বাগানের ফুলগুলো সুমিষ্ট গন্ধে ভরিয়ে তোলে আকাশ, বাতাস, স্বর্গ, মর্ত্য।
এইভাবেই কেটে যায় প্রায় একমাস। বিদায়ের পালা এবার। বাসুদেবের হঠাৎ জীবনে
নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
এবার আমাদের ফিরতে হবে।
বাসুদেবের চারিদিকে সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঘুরতে থাকে সারা পৃথিবী। চোখের জল যেন বাঁধ মানে না। ছোট্ট তিতলির পা জড়িয়ে ভেঙে পড়ে বাসুদেব।
আমরা ফিরে আসব নিশ্চয়ই...
নৌকায় চড়ার সময় ছোট্ট তিতলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে শেষবার বাসুদেবের
দীর্ঘশ্বাস যেন আকাশ বাতাসকে চূর্ণ করে।
ফিরে আসার দু’দিনের মধ্যে ফোন আসে।
ছোটসাহেব আমি লক্ষী। ঝুমুরগঞ্জ থেকে বলছি। বাসুদাদা আর নেই। গতকাল রাতে মারা
গেছেন। আমরা আজ সকালে এসে দোতালায় টিয়াপাখির খাঁচার সামনে তাকে মরা অবস্থায়
পাই। আপনারা পারলে একবার আসুন। বাড়িটার চাবি নিয়ে যান।
ঝুমুর নদী ছলাৎ ছলাৎ চলে।
No comments:
Post a Comment